poet
stringclasses 137
values | category
stringclasses 21
values | poem
stringlengths 9
18.7k
|
---|---|---|
শামসুর রাহমান | সনেট | ক-এর আঙুল থেকে একটি কী পথ বহুদূরে
গ্যাছে বেঁকে চিত্রবৎ, বৃক্ষশ্রেণী যেন দেবদূত,
পৃথিবীর নিসর্গের বন্দনায় কেমন নিখুঁত
সৌন্দর্যে এসেছে নেমে আসমান থেকে নম্র উড়ে।
ক-এর ওষ্ঠের তটে তৃষ্ণার্ত হরিণ ঘুরে ঘুরে
ফিরে যায় বারংবার জলকষ্টে, হিংস্র পদচ্ছাপ
চোখের নিচের বালিয়াড়ি ধরে রাখে, হলদে সাপ,
কেবলি দলতে থাকে সাবলীল তার গলা জুড়ে।সে পথের কাছে আজ ক-এর কী বলার আছে?
পথ বড় উদাসীন, নিশ্চুপ সর্বদা। তার ভাষা
বুঝলেও কখনো দেবো না সাড়া; ক-এর মুখের
ভেতরে আদিম জলপরী এবং কিন্নরী নাচে,
পাঁজর-প্রান্তরে বুকভাঙা ডাক ঘোড় সওয়ারের।
সে-পথ রাখে না মনে কারো চলে-যাওয়া,ফিরে-আসা। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | কখনো কিছু না কিছু পেয়ে যাই, বন্ধু উপহার
পাঠান হঠাৎ কিংবা প্রবাসী ভায়ের চিঠি আসে
সুদূর শহুরে ঘ্রাণ নিয়ে, কখনো দেয়ালে এসে
বসে সুদর্শনা পোকা, যেন তার কপালের টিপ।কখনো বা পেয়ে যাই অন্ধকারে আমার ঠোঁটের
তীরে তার দীপ্ত তন্বী অধর তরণী। অন্য ঘর
থেকে ভেসে-আসা চঞ্চল চুড়ির কাচরেলা শব্দে
বুকে জেগে ওঠে লক্ষ অশ্বারোহী; ক্ষুরধ্বনি পাই।কোনো কোনোদিন খুব শান্ত হরিদ্রাভ অপরাহ্নে
সেলাইয়ের কাজ ছেড়ে কখনো মা এমন তাকান
নিবিড় আমার দিকে, সমস্ত শৈশব দুলে ওঠে-
চকিতে আবার পাই তাঁকে কাছে সতেজ তরুণী।কখনো গলির খঞ্জ কিংবা বন্ধ নীলাভ দরজা
আমার মগজে কবিতার কিছু পঙ্ক্তি গুঁজে দেয়। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | আজ ভোরবেলা থেকে মন ভালো নেই। কিছুতেই
পড়াশুনা লাগছে না ভাল, এমনকি পদ্য লিখে
মন খারাপের ঘন মেঘ পারি না উড়িয়ে দিতে।
রিকশায় চলেছি লেক সার্কাসের মোড়ে; অভ্র-গুঁড়ো
ঝরায় আকাশ, সন্ধ্যা হয় হয়, বেপরোয়া ঢঙে
ক’জন যুবক হাঁটে ফুটপাতে, বেজে ওঠে শিস
মাঝে মাঝে। মনে পড়ে হৃদয়ের উঠোনে আমার
এখনো পূর্ণিমা জ্বলে, জ্বলবে কি আরও কিছুকাল?
সে কেমন আছে? কি করছে ভেজা ধোঁয়াটে সন্ধ্যায়?
আমাকে কি মনে পড়ে তার, যখন সে বসে থাকে
বারান্দায় খুব একাকিনী, হাতে আধপড়া বই,
কিংবা কাঠবিড়ালির খেলা দেখে কাটায় সময়,
দাঁতে চেপে আঙুল অতীত নিয়ে বোনে তন্তুজাল?
যেন আমি হাড়কাঠে গলা দিয়ে বসে আছি, কাকে
জানাব আমার কথা? কে বুঝবে ভাষাহীন ভাষা?
রাস্তায় ঝিমোচ্ছে বসে লোলচর্ম অসুস্থ মহিষ। (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | লোকটা বুড়োই বটে, অতিশয় স্মৃতিভারাতুর।
স্মৃতিমোহে সে একাকী সন্ধ্যায় কবরে দীপ জ্বালে
কোনো কোনো দিন খামখেয়ালের আঁকাবাঁকা খালে
প্রায়শ ভ্রমণ করে কাটে তার বেলা। মদে চুর
(খাঁটি দেশী) প্রতিরাতে, ক্লান্ত মনে তার দেয় হানা
বোমারু বিমান ঝাঁক ঝাঁক, দ্যাখে গ্রামে কি শহরে
লোক মরে লক্ষ লক্ষ, ইউরোপ আর্তনাদ করে
চকচকে হিটলারী বটের তলায়। লাশটানাগাড়ি খুব এঁটেল কাঁদায় ডুবে যায়। কানে আসে
বন্ধ গ্যাস ঘরে দগ্ধ মানুষের বিকট চিৎকার।
শোনে সে এখনো মরু শেয়ালের হাঁক, পোড়া ঘাসে
বুট ঘষে জেনারেল। ট্যাঙ্ক চলে, ক্ষেত ছারখার।
লোকটা বুড়োই বটে, তবু আজ স্বপ্ন দ্যাখে, সুখে
সে ঘুমায় একা জলপাই বনে তরুণীর বুকে। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | একজন দীর্ঘকায় লোক গলি থেকে
বেরিয়ে প্রধান পথে মাথা উঁচু ক’রে
হেঁটে হেঁটে সামনে এগোতে থাকে। অকস্মাৎ এ কি!
লোকটা মোমের মতো ধীরে
গলে যেতে থাকে আর পথচারী অনেকেই তার
দিকে অতিশয় বিচলিত দৃষ্টি গেঁথে দেয় যেন।কারও দিকে দৃষ্টি নেই চলন্ত, গলন্ত লোকটার। পথে জমে
ক্রমাগত পথচারীদের ভিড়। কোন্
কে যে তীক্ষ্ণ খঞ্জর বসিয়ে দেয় বুকে,
এমন দুশ্চিন্তা নড়ে চড়ে মাঝে মাঝে,
যেমন ইঁদুর কোনও ক্রিয়াপ্রিয় বিড়ালের মতো।
আসমানে কৃষ্ণ মেঘমালা চন্দ্রমাকে গ্রাস করে!শহরে পড়েছে ঢুকে জাঁহাবাজ ডাকাতের দল
চারদিক থেকে, ভীত-সন্ত্রস্ত শহরবাসীদের
চোখ থেকে গায়েব হয়েছে ঘুম। নারীদের সম্ভ্রম হানির
আশঙ্কা এবং পুরুষের শোণিতের বন্যা বয়ে
যাওয়ার শিউরে-ওঠা রক্তিম প্রহর কাটাবার
চেতনা, সাহস আর বিজয়ের ধ্বনি কখন তুলবে কারা?
যখন শহরবাসী হতাশার হিম-অন্ধকারে
হাবুডুবু খাচ্ছিল, হঠাৎ চৌদিক থেকে আলো
জেগে ওঠে আর কিয়দ্দূর থেকে অপরূপ গীত
ভেসে আসে। কী আশ্চর্য! গলিত মোমের
স্তূপ থেকে দীর্ঘদেহী রূপবান পুরুষেরা জেগে
উঠে শক্র-তাড়ানোর যুদ্ধে জয়ী হতে ছুটে যায়। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | সবাই দেখল তাকে বিস্ময়ের উন্মুখ চৌকাঠে,
দাঁড়িয়ে দেখল তার শীর্ণ হাতে একমুঠো তারা,
খেলছে সে-যেন কতগুলো ঝকঝকে টাকা
নেড়েচেড়ে দেখছে তন্ময় হয়ে মুগ্ধতার ঘুলঘুলি দিয়ে।
নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তারা দশজন
দেখল সে শুয়ে-শুয়ে বৃষ্টির ঝাঁঝালো মদে ডুবে
খুঁজছে সোমত্ত নৌকো তার ভেজা ঠোঁটে কিনারে
চুমো খাবে বলে। তারা শুধু পরস্পরপিটপিটে চোখ টিপে দেখল কানের জানালায়
নির্ভার অস্তিত্ব এক বসেছে নিঃশব্দে। পৃথিবীর
সমস্ত স্তব্ধতা যেন শরীরে রেখেছে ঘিরে সেই আগন্তুক।
সবাই বলল তাকে, পাখিটাকে-শুয়োরের তাজা
টকটকে মাংসের পিণ্ডের মতো সন্ধ্যার সাক্ষাতে-
সবাই বলল তাকে সমবেত কণ্ঠের ক্রেঙ্কারে
‘গাও পাখি গান গাও, এ প্রহর গানের প্রহর।
নিষ্কম্প স্তব্ধতা দেখে তারা ফের দ্বিগুণ বিক্রমে
করল গানের ফরমাশ। নৈঃশব্দের দরবারে
তবুও হল না উন্মীলিত ফুলের পাপড়ির মতো কোমল গান্ধার।
চুরুট রঙের কোট ছুড়ে ফেলে, ফটোগ্রাফারের
কালো কাপড়ের মতো পর্দা টেনে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে
এক পশলা তারা সে-লোকটা (সবাই দেখল যাকে)
তাকাল পাখির ছোট দুটি সোনালি চোখের দিকে।
হাতের মুঠোয় তারা চকিতে উঠল বেজে রুপালি মুদ্রার
ঝনঝনে শব্দের মতো, পাখির চোখের দুটি তারা
ঝরাল আলোর দ্যুতি লোকটার কম্পিত মুঠোয়। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | মেঘের কাঁথায় মুখ লুকায় দুঃখী চাঁদ,
মধ্যরাতের নির্বাক রাস্তায়
অভাজনের কাতর প্রার্থনা;
ভাঙা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে
রুটির টুকরোর মতো সৃষ্টিকণা
ভিক্ষা চাইছি নিয়ত।সঙ্গীতচিহ্নিত জ্বলজ্বলে আকাশ থেকে
হঠাৎ কে আমাকে ছুঁড়ে দিলো
স্তব্ধ ধূসরতায়?
ঝর্ণা আমার আঙুলে,
এই বিশ্বাসের শেকড় ছিলো মজবুত,
অথচ সম্প্রতি তুষারিত সেই প্রস্রবণ।আমার হাতে একলব্যের রিক্ততার হাহাকার;
কে আমাকে বলে দেবে
কোন দ্রোণাচার্যের পায়ের তলায়
লুটোচ্ছে আমার খণ্ডিত গৌরব? (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | জানতাম অসম্বব, তবু কলকাতার কলরবে
তোমার মধুর কণ্ঠস্বর শুনি অতিথি নিবাসে
আমার অস্থায়ী ঘরে। প্রত্যুষের পাখির সঙ্গীতে
জেগে উঠে দেখি একি রয়েছে দাঁড়িয়ে নিরিবিলি
চায়ের পেয়ালা হাতে। বসলে শয্যার ধারে এসে,
তোমার চুলের ঢল নামে আমার মুখের পরে,
আমার জাগ্রত ওষ্ঠে ফোটে কিছু চুমোর কুসুম,
সারা ঘর ভরে যায় অপরূপ তোমার সৌরভে।শান্তিনিকেতনে, খোয়াই-এর তীরে, রামকিঙ্করের
কঙ্কালীতলার পথে যেতে দেখি হঠাৎ গৌরীকে।
ছাতিমতলায় বসে আছে একাকিনী গোধূলিতে,
সন্ধেবেলা কবিতা উৎসবে দ্যাখে কবিতা পড়তে
আমাকে তন্ময় হয়ে, যে কবিতা বস্তুত রচিত
তারই জন্যে, জ্বলে আসমানে কালপুরুষ নীরবে। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | অগ্রসরমান, অগ্রসরমান, অগ্রসরমান, অতি দ্রুত
চতুর্দিক থেকে
নিরেট দেয়াল, সত্তা-চেপে-ধরা, দম-বন্ধ করা;
দেয়ালের গায়ে সংখ্যাহীন
সনাতনী উদ্যত তর্জনী, নিত্যদিন তার হাসি মুছে-ফেলা।
কেউ কেউ ঢেলা ছুঁড়ে মজা লোটে, কেউবা শাসায়
সর্বক্ষণ নানা ছলছুতোয়, সে নারী মাথা কোটে
বিরূপ বাসায়, ছেঁড়া সুতোয় সেলাই করে পীড়িত যৌবন।কপালে, কোমরে, বুকে, হাতের চেটোয়, দু’টি পায়ে
জন্মান্ধ পেরেক ঠুকে দিচ্ছে বর্বরেরা; অট্রহাসি,
উপহাস অবিরত, থুতু এবং দেয়ালঘেরা
জীবন হাঁপায় জীর্ণ হাপরের মতো,
তৃতীয় প্রহরে
তার ফোঁপানিতে
উনিশ শো নব্বই সালের ধুকপুক, বুকফাটা
আওয়াজ, দূরন্ত বাজপাখি
চক্রাকারে উড়ে
ঠুকরে ঠুকরে খায় তার আর্ত হৃৎপিণ্ড অবেলায়।অলৌকিক কিছু ঘটবে না। ‘ধিক তোকে, এই ধ্বনি
অন্ধকার থেকে
উথিত, সে ত্রস্ত ভীত, ক্লান্ত, মূক মুখ
হাতে ঢাকতেও পারছে না। গলগল
রক্তবৃষ্টি, বিফল গোধূলি, বিচ্ছিন্নতা মহাগ্রাস;
এক্ষুনি থামাও নারকীয় ক্রিয়াকর্ম, আলগোছে
নামাও তোমরা ওকে পীড়নের মঞ্চ থেকে, ঢেকে
দাও ওর কান্নায় উথলে-ওঠা ক্ষত
জ্যোৎস্না-চন্দ্রনের মসলিনে কতকাল
যন্ত্রণা পাঁজর খুলে নিয়ে
সাজাবে কংকালকীর্ণ উদগ্র উদ্যান? ধ্যান তার
প্রখর অঙ্কুশে বিদ্ধ, কবিতার ভ্রূণাবস্থা কাটে
কালেভদ্রে এ দারুণ জন্মের খরায়। আছড়ায়
অস্তিত্বকে শুধু ড্রাগ ত্র্যাডিক্টের মতো।কোথাও প্রহরী নেই, তবু
সতর্ক পাহারাদার সবদিকে। সন্ধিগ্ধ, খণ্ডিত আসমান,
অবিরত লাঠি ঠোকা, চোখা, একরোখা বল্লমের অন্ধ ক্রোধ;
উনুনের পোড়া দাগ কাঁটার্ত চোখের
নিচে, আপাতত শায়িতা সে,
আহত সৌন্দর্য নিয়ে বিপন্ন, বিব্রত; স্নায়ুগুলো
ছটফটে, যেন বাইপাস সার্জারির
সুঁচোলো অপেক্ষা, ঝুঁকে-থাকা কিছু পাহাড়ি শকুন,
পক্ষীতত্ত্ববিদের বিষয়ে উদাসীন,
ছড়ায় আগ্রাসী ছায়া চঞ্চু নেড়ে নেড়ে। মুহূর্তেরা
চূর্ণ কাচ, ছেঁড়া-খোঁড়া স্বপ্ন, ভূলুণ্ঠিত
সৌন্দর্যের স্পর্ধা নিয়ে সে কি টান টান উঠে
দাঁড়াবে আবার? (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | পার্কের নিঃসঙ্গ খঞ্জ চেয়েছে চাঁদের কাছে বুঝি
একটি অদ্ভুত স্বপ্ন তাই রাত্রি তাকে
দিল উপহারবিষাদের বিস্রস্ত তনিমা
যেন সে দুর্মর কাপালিক
চন্দ্রমার করোটিতে আকণ্ঠ করবে পান সুতীব্র মদিরাপৃথিবীতে সম্পন্ন গাছের পাতা ঝরে
হরিণের কানের মতন পাতা ঝরে ধ্বনি ঝরে
উজ্জ্বল মাছের
রুপালি আঁশের মতো ধ্বনি ঝরে ঝরে ধ্বনি
ঝরে পৃথিবীতে
সে ধ্বনির আকাঙ্ক্ষায় জ্ব’লে ততদিন সে-ও
থাকবে পথের প্রান্তে প্রতীক্ষার ঘাটে
যতদিন সহজে ভাসানো চলে সোনার কলসরৌদ্রের দস্যুতা জেনে বৃষ্টির আঁচড়ে
মুহ্যমান দুঃখের দর্পণে দেখে মুখ
বাসি রুটি
চিবোয় অভ্যাসবশে জ্যোৎস্নাজ্বলা দাঁতে
আর স্মৃতিগুলি একপাল কুকুরের মতো
খিঁচিয়ে ধারালো দাঁত মনের পিছনে করে তাড়া
ভাবেএকতাল শূন্যতায় ভাবে
বেহেস্তের ছবি যায় কশাই চামার
ছুতোর কামার আর
মুটে মজুরের ঘরে আর দরবেশের গুহায়
বাদশার হারেমে সুন্দরী বাঁদী যদি
বিলাসের কামনার খাদ্য হয় সোহাগ জোগায়
বিলোল অধরে
গড়ায় ক’ফোঁটা পানি ক্ষুধিত পাষাণে
অথবা নুলোর বউ কাঁদে ভাদ্রের দুপুরে
তবে যে লোকটা হেঁটে যায়
বিকেলের মোলায়েম রোদে
তার কীবা এসে যায়অন্যের দুঃখের নদী বয়ে যেতে দেখে
আমরা সবাই কম বেশি
স্বস্তির হাওয়ায় ভাসি নিজের ফাঁড়ার কথা ভেবে
একচ্ছত্র ক্ষুধার সাম্রাজ্যে ঘুরে ঘুরে
ধুলো ঘেঁটে ছাই ছেনে হৈ হৈ ছেলেদের
দৌরাত্ম্যে অস্থির
ফিরে আসে পার্কে এই নিরানন্দ বাদামের খোসা
ভবঘুরে কাগজের অভ্যস্ত জগতে
যেখানে অনামি
বাউণ্ডুলে ময়লা ভিখিরি আর লম্পট জোচ্চোর
গণ্ডমূর্খ আর ভণ্ড ফকির অথবা
অর্ধনগ্ন ভস্মমাখা উন্মাদিনী বেহেড মাতাল
এসে জোটে সন্ধ্যার আড়ালে
যখন কোথাও
রজনীগন্ধার ডালে কাগজের মতো চাঁদ বোনে
স্বপ্নের রুপালি পাড়অর্ধদগ্ধ বিড়িটাকে শুকনো ঠোঁটে চেপে
তাকায় রাস্তার ধারে চাঁদহীন মাঠে
অদ্ভুত বিকৃত মুখে যেন
পৃথিবীর কোনো সত্যে সৌন্দর্যে কল্যাণে
আস্থা নেই তার যেন একটি কর্কশ পাখি
আত্মাকে ঠুকরে বলে তোমার বাগান নেই বলে
রক্তিম গোলাপ আসবে না
বিকলাঙ্গ স্বপ্নের অলিন্দে কোনো দিন
জানে তার নেই ঠাঁই সুন্দরের কোলে
নুলোর বউটা তবে তাকে
থাক থাক
এসব কথার বুজরুকি
কখনো সাজে কি তার চালচুলো নেই যার এই
দুনিয়ার ঘরেরোঁয়াওঠা কুকুরের সাহচর্য্যে গ্রীষ্মের গোধূলি
হয়তো লাগবে ভালো রাত্রি এলে চাঁদ
হয়তো অদ্ভুত স্বপ্ন দেবে তার সত্তার মাটিতে
বিষাদের ঘরে
কেউ জাগাবে না তাকে
পার্কের নিঃসঙ্গ খঞ্জটাকে (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | গাঁয়ের নাম অনুক্ত থাক। সে গাঁয়েরই এক যুবক,
নাম তার, ধরা যাক, আক্কাস আলী।
সে তাদেরই একজন যারা অতিশয়
আলসে আর অকর্মার ধাড়ি। প্রায়শই তাড়ি গেলে
এবং সুযোগ পেলেই কোনো
তন্বীর শাড়ির আঁচল ধরে টানে
তবে হঠাৎ কী করে যে সেই যুবকের মধ্যে
এক মজাদার পালাবদলের খেলা
শুরু হয়ে গেল,
গাঁয়ের কেউ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
অনেকেই একে তেলেসমাতি কাণ্ড বলে
মনে করে, কেউ কেউ আড়ালে বলে আঙুল ফুলে কলাগাছ।
যুবকটি কেমন চটপটে হয়ে উঠেছে রাতারাতি,
লুঙ্গির বদলে ওর গায়ে এখন
পাৎলুন, ছেঁড়া গেঞ্জিকে হটিয়ে জায়গা করে নিয়েছে
চক্রাবক্রা কামিজ আর পায়ের হাজা
ঢাকা পড়েছে একজোড়া সিল্কের মোজা আর চকচকে
জুতোর আড়ালে। অষ্টপ্রহর ওর চোখে থাকে
রঙিন চশমা, কব্জিতে ঝলমল করে ঘড়ি।
ইদানীং ওর বোলচালও ভোপাল্টানো মানুষের
মতো। ওর হতশ্রী ছনের ঘর
এখন রূপসীর মতো দালান আর সেখানে চালান
করেছে টুকটুকে বউ
কন্যাদায়গ্রস্ত এক বাপ। যুবক বউ আর
কখনোসখনো ফাউ মেয়েমানুষ,
ট্রানজিস্টার আর টিভি নিয়ে ধুমসে করছে
জীবনযাপন। আপন বলতে তার
তেমন কেউ নেই, তবে ওকে ঘিরে নানা জন
ভন্ভন্ করে, যেমন গুড়ের আড়তে মাছি। উড়ো কথা কানে আসে,
আক্কাস আলীর নাকি প্রধান শহরের
উপর-অলাদের সঙ্গে বেজায় দহরম মহরম।
ফলত ওর পোয়া বারো।সে গাঁয়েরই এক বর্ষীয়ান লবেজান কৃষক মধ্যরাতের
গভীর অন্ধকারে দু’চোখ মেলে ভাবেন,
আক্কাস আলীর এই আচানক পরিবর্তনের মাজেজা কী?
খটকা লাগে তার মনে। এই গেরামে
শহর থেকে আসা যে নওজোয়ানরা ক্ষেতমজুরদের
শোনাত নয়া দুনিয়ার কথা, বোঝাত
গরিব গুর্বোদের সুদিন আনার তরিকা, তাদের কেউ কেউ
গায়েব হয়ে গেছে, কারো কারো বিকৃত লাশ
পাওয়া গেছে বনবাদাড়ে।
আচ্ছা, সেই বর্ষীয়ান কৃষক ভাবেন,
এই হাদেশার সঙ্গে আক্কাস আলীর তাক্-লাগানো
তরক্কির কোনো সম্পর্ক নেই তো?এই কথার ঢিল কি তিনি ছুড়বেন পানাপুকুরের মতো
নিস্তরঙ্গ গেরামে? তাহলে কি তিনিও একদিন
গুমখুন হয়ে যাবেন না? মুখে কুলুপ এঁটে
কারও সাতে পাঁচে না থাকাই ভালো।
কী দরকার ফ্যাঁসাদ বাড়িয়ে? আগামীতে তিনি কী করবেন,
কিছুতেই মনস্থির করতে পারলেন না।
সিদ্ধান্তহীনতায় শুধু তিনি ভোরের অপেক্ষায়
পুরোনো বিছানায় পড়ে রইলেন, দু’চোখে ধ্বকধ্বকে জ্বালা (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | ত্র্যালবামের এই চেনা জানা
সংসারে আজ নেই যে তিনি।
কেমন ধূসর, কতো ধূসর ক্রমান্বয়ে
হলেন তিনি, বলতে পারো মনো-মুকুর?গলির কোলে আটচালাটা
অষ্টপ্রহর আদর খেতো
রৌদ্র ছায়ার। কখনো বা উঠতো কেঁপে
বদমেজাজী হাওয়ার ভীষণ ধমক খেয়ে!আটচালাটা তাঁরই ছোঁয়ায়
হয়েছিলো আয়ুষ্মতী।
সেই কবেকার খেজুর পাতার ঝিলিমিলি
ঝালর রচে আজো এমন দূর দশকে।একলা দুপুর উদাস হতো
আমার মাতামহীর বুকে।
রৌদ্র যখন পারদ হ’য়ে টলটলাতো,
বলতেন তিনি, ‘দুপুর তুমি কার বলো তো?’শীতল পাটির স্নিগ্ধতাকে
নিতেন শুষে দেহের ভেতর।
হঠাৎ কখন বুক জুড়ে তাঁর উঠতো কেঁপে
প্রাচীন কোনো পথের রেখা, জানতো না কেউ।
এক নিমেষে শীতলপাটি
বদলে হতো কাঁটার ভুবন।
কখনো ফের তাঁর আয়ত চোখের নিবাস
যেতো ভেসে কংকাবতীর চোখের আলোয়।যাদব চক্রবর্তী মশাই
হিশেব টিশেব শেখান নিকো,
তবুও তার কাঠের বাক্সে মুদ্রাগুলো
হিশেব মতো উঠতো নেচে পরীর মতো।কিন্তু যখন বেহিশেবী
নাছোড় দুপুর আলু থালু
করতো তাঁকে, তখন স্মৃতির পরগণাতে
উড়তো শুধু পাগলা ঘোড়ার ক্ষুরের ধূলি।যায়না দেখা কোথাও তাঁকে
সকাল সন্ধ্যা দ্বিপ্রহরে,
মাঝে-মধ্যে বিষাদ সিন্ধু ছাপিয়ে উঠে
উদ্ভাসিত মাতামহীর মুখের রেখা। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | কখনও সখনও যে চা-খানায় চা খেতে যাই কিংবা কিছু সময় কাটাতে,
সেখানেই তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বলা-কওয়া নেই লোকটা গ্যাঁট হয়ে
বসল আমার মুখোমুখি। কোনও কোনও মানুষ আছে যাদের দেখলেই মনে
পড়ে পাখির কথা। লোকটা সে ধরনের একজন মানুষ। কেন জানি না, তাকে
মনে হলো একটা দাঁড়কাকের মতো, যদিও এই বিশেষ প্রাণীটির সঙ্গে তার
কোনও মিল আমি খুঁজে বের করতে পারিনি। পক্ষান্তরে লক্ষ করলাম, ওর
ভুরুতে বনস্থলির শ্যামলিমা, হাতের নোংরা নোখ থেকে বেরিয়ে এসেছে গুচ্ছ
গুচ্ছ রক্তকরবীর লালিমা, ঠোঁটে সমুদ্রতটের নুন, চোখে কবরের ভেতরকার
রহস্য। সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়ছিল, সে এসেছে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত
থেকে।
আমার চায়ের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে লোকটা তাকাল রাস্তার দিকে, তারপর
বলতে শুরু করল একটি কাহিনী; আমি শুনতে চাই কিনা সে-কথা জানতেও
চাইল না। কথার বড়শি দিয়ে সে গেঁথে ফেললো আমাকে। কার সাধ্য সেই
বড়শি থেকে ছাড়া পায়? তার কথা বলার ধরন থেকে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে
উঠল আমার কাছে যে, সে এক প্রাচীন ভ্রমণকারী। নানা ঘাটের পানি খেয়েছে
লোকটা। ওর গলায় বহু অতিজ্ঞতার মিশ্র স্বর, এক চিত্ত-আলোড়নকারী
ঐকতান। আমার ওপর দিয়ে বয়ে গেল ঢেউয়ের পর ঢেউ। বিচিত্র মশলার
ঘ্রাণে ভরে উঠল সেই চা-খানা, আমি অনুভব করলাম পাখির বুকের উত্তাপ,
সুদূরতম দ্বীপের ওপর বয়ে যাওয়া হাওয়ার ঝলক, ঝরনার স্বচ্ছ জলের
শীতলতা। সে তার কাহিনী শুরু করল এভাবে-
এক ঝাঁক দাঁড়কাক এসে বসল উঁচু দেয়ালে, যেন পুঞ্জ পুঞ্জ হিংসা। ওদের
পাখায় লেখা আছে একটা শব্দ, প্রতিশোধ। দাঁড়কাকগুলো দশদিক চমকে
দিয়ে চিৎকার করতে শুরু করল, আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ল কুচকুচে কালো
রঙ। দাঁড়াকাকদের গলা সেই রঙের উৎস। একে একে ওরা উড়ে গেল
প্রাসাদটির প্রতি, ফিরে এল একটু পরে; ফের হানা দিল সবাই এক সঙ্গে।
চঞ্চুর আঘাতে আঘাতে ওরা ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলতে চাইল ফটকটিকে। সেই
প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে ওরা ভেতরকার রহস্য জেনে নিতে চায়, জেনে নিতে
চায় এমন কী আছে প্রাসাদের ভেতরে যা রাখতে হবে সবার চোখের আড়ালে?
মোদ্দা কথা, ওরা প্রাসাদটিকে দখল করতে চায়। কিন্তু আপাদমস্তক দামি
ধাতুতে মোড়া প্রহরীদের বন্দুকের ধমকে ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল, কালো
কালো ছেঁড়া পালকে ছেয়ে গেল চারদিক, দাঁড়াকাকগুলো রাশি রাশি মণ্ডের
মতো পড়ে রইল। ফটক ছিদ্র করবার মতো শক্তিমান ছিল না ওদের চঞ্চু।
আর ওরা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রহরীদের বর্মের ঝলসানিতে। প্রহরীরা বীরদর্পে
দাঁড়কাকের শবের ওপর কুচকাওয়াজ করল কিছুক্ষণ; কুচকাওয়াজ,
কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ।
দাঁড়কাকদের পরাজয়ের পর দিন যায়, দিন যায়। সময়ের ঠোকরে চিড় ধরে
না প্রাসাদের প্রাচীরে। খোলে না ফটক। খুললেও কারও প্রবেশাধিকার নেই
সেখানে, শুধুমাত্র নির্বাচিতরাই যেতে পারে ভেতরে। যারা যায় তারা আর
ফিরে আসে না। প্রাসাদের প্রাচীরে কিংবা গম্বুজে কাকপক্ষীও বসতে পারে না।
দামি ধাতুতে মোড়া প্রহরীরা অষ্টপ্রহর প্রস্তুত। একটা পিঁপড়ে ওদের চোখ
এড়িয়ে যাবে, এমন ফাঁকফোকর ওরা রাখেনি কোথাও। প্রাসাদ আছে
প্রাসাদের হালে, কখনও কখনও ভেতর থেকে ভেসে আসে নানা বাদ্যরব,
নর্তকীদের মঞ্জীর-ধ্বনি। ফটকের বাইরে সকাল সন্ধ্যা প্রহরীরা করে
কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ।
হঠাৎ একদল শিম্পাঞ্জী সেই প্রাসাদের ওপর চড়াও হলো একদিন। কিন্তু ওদের
উৎপাত স্তব্ধ হয়ে গেল এক পশলা বুলেটে একটা আঁচড়ও লাগল না
প্রাসাদের গায়ে। পরাভূত শিম্পাঞ্জীদের অনেকেই বেঘোরে প্রাণ হারাল, যারা
বেঁচে রইল তাদের বেঁচে না থাকাই ছিল ভালো। কেউ হারাল হাত, কেউ পা,
কেউ কেউ হাত-পা দুটোই। প্রহরীদের বর্মে সূর্যের আলোর ঠিকরে পড়ে,
ঝলসিত হয় চতুর্দিক। শিম্পাঞ্জীদের শবের ওপর প্রহরীরা বীরদর্পে
কুচকাওয়াজ করল কিছুক্ষণ, কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ।
শিম্পাঞ্জীদের পরাজয়ের পর দিন যায়, দিন যায়। পূব দিকে সূর্য ওঠে, পশ্চিমে
অস্ত যায়। গাছে পাতা গজায়, পাতা ঝরে যায়। প্রাসাদ থাকে প্রাসাদের হালে;
ঝকঝক করে সূর্যের আলোয়, অন্ধকারকে শাসন করে নিজস্ব আলোর ছটায়।
শোনা যায় প্রাসাদের ভেতরে বারো মাস তেরো পার্বণ কাটে প্রায় একইভাবে,
একই তালে লয়ে। মাঝে-মাঝে গুঞ্জন রটে বাইরে। গুজব গুজবই। তাই ওসব
নিয়ে মাথা ঘামানোর লোকের সংখ্যা কম। প্রহরীরা টহল দিয়ে বেড়ায়
প্রাসাদের চারদিকে। দিনভর, রাতভর। কোনও কিছু নড়তে চড়তে দেখলেই
বলে, হল্ট। সহজে কেউ ঘেঁষে না ফটকের কাছে, দূর থেকে তাকায় আড়
চোখে। লোকে বলে, কোনও কোনও মধ্যরাতে প্রাসাদের প্রাচীরগুলি ডুকরে
ওঠে ট্রয় নগরীর রমণীদের বিলাপের মতো।
শিম্পাঞ্জীদের পরাজয়ের বহু বছর পরে শত শত লোক ছুটে এল প্রাসাদের
দিকে লাঠিসোটা আর দা-কুড়াল নিয়ে। মনে হলো জনবন্যায় দেশলাইয়ের
বাক্সের মতো ভেসে যাবে প্রাসাদ। কিন্তু ঝাঁক ঝাঁক বুলেট আর কামানের
গোলায় বন্যার গতি হলো রুদ্ধ, মৃত্যু এলোপাতাড়ি উপড়ে নিল বহু প্রাণশস্য।
যারা এসেছিল প্রাসাদের প্রাচীর চুরমার করার জন্যে, ফটকটিকে কাগজের
মতো দুমড়ে ফেলার জন্যে, ব্যর্থ হলো তারা। ওরা এসেছিল একটা সূর্যোদয়ের
জন্যে, ফিরে গেল অস্তিত্বময় অমাবস্যা নিয়ে। তখন আমি জ্বলজ্বলে যুবক,
সবেমাত্র কুড়ি পেরিয়েছি। আমার হাতের মুঠোয় স্বপ্নের চারাগাছ, চোখে
সামুদ্রিক ঢেউয়ের ঝাপটা, আমার সত্তায় ভবিষ্যতের লাবণ্য।
যাকগে, মানুষের সেই পরাজয় আমি প্রত্যক্ষ করেছি। এত লাশ আমি এর
আগে দেখিনি। চোখে জ্বালা ধরে যায়। মৃতদেহ এত আগুন, কে জানত? চোখ
পড়ে যায়। কেউ কেউ বাঁচল পালিয়ে, কিন্তু সেই বাঁচার চেয়ে মরাই ছিল
ভালো। আসল পা ছেড়ে কাঠের পা নিয়ে কে বাঁচতে চায়? কে চায় হুইল
চেয়ারে বসে ঝিমোতে? চোখের জ্যাতি হারিয়ে দিন যাপনের গ্লানি সইতে কে
চায়? প্রিয় সঙ্গীর মুণ্ডুহীন ধড় দেখার পর কেউ সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গে
হাত মেলাতে পারে না। আপাদমস্তক দামি ধাতুতে মোড়া প্রহরীরা মানুষের
লাশের ওপর কুচকাওয়াজ করল কিছুক্ষণ; কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ,
কুচকাওয়াজ।
সেই পরাস্ত লোকগুলোর মধ্যে ছিল একজন জিপসি। বেখাপ্পা তার
জীবনযাত্রা, অদ্ভুত তার আচরণ। ওরা পালিয়ে এসে ডেরা বাঁধল বহুদূরে, নদী
তীরে। লোকগুলো বসেছিল গোল হয়ে ফ্রেস্কোর মণ্ডলের মতো। কারও মাথায়
ব্যাণ্ডেজ, কারও উড়ে-যাওয়া পায়ের অবশেষে ব্যাণ্ডজ, কারও চোখে
ব্যাণ্ডেজ। জিপসিটা বলল, মনমরা হয়ে থেকো না তোমরা। যারা একদিন
বীরের মতো প্রবেশ করবে সেই প্রাসাদে আপাদমস্তক দামি ধাতুতে মোড়া
প্রহরীদের পরাস্ত করে তারা বাড়ছে গোকুলে। ওরা কারা? জানতে চাইল
সবাই। জানি না; তবে ওরা আসবে, দূর দিগন্তের দিকে দৃষ্টি মেলে উত্তর দিল
সেই জিপসি। কবে আসবে সেদিন? একটা গুঞ্জন উঠল আহত লোকগুলোর
মধ্যে। সেই বিজয়ের দিন কবে আসবে? এই প্রশ্ন তীরের মতো ছুটে গেল
জিপসির দিকে। জিপসির চোখে কী একটা ছায়া দুলে ওঠে যেন, আকাশে
ঝুলে আছে যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া চোখের মতো চাঁদ। জিপসি স্বপ্নঝলসিত কণ্ঠ
বলে, বিজয়ের নির্ধারিত কোনও তারিখ নেই।
এটুকু বলে থামল আমার মুখোমুখি বসে-থাকা লোকটা। জিপসির সেই বাণী,
বিজয়ের নির্ধারিত কোনও তারিখ নেই, গুঞ্জরিত হতে থাকল চা-খানায়, যেন
শুনতে পেলাম আমি। হঠাৎ দাঁড়কাকের মতো লোকটা চেয়ার ছেড়ে উঠে
দাঁড়াল, রওনা হলে রাস্তার দিকে। আমি তাকে ডাকলাম, কিন্তু সে ফিরে
তাকাল না পর্যন্ত। যেন আমি কোনও ধর্তব্যের মধ্যেই নেই। লোকটার হাঁটার
ভঙ্গিতে কোনও স্বাভাবিকতা ছিল না। খট খট করে একটা শব্দ হচ্ছিল। তখুনি
আমি প্রথমবারের মতো লক্ষ্য করলাম, লোকটার একটা পা কাঠের। আর
সেই কাঠের পা থেকেই বিজয়ের কোনও নির্ধারিত তারিখ নেই শব্দগুচ্ছ
মুঞ্জুরিত হয়ে চা-খানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ল চরাচরে। (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | (মনসুর আহমদ স্মরণে)তোমার কিসের তাড়া ছিলো অত? কেন তুমি সাত
তাড়াতাড়ি এই গুলজার আড্ডা থেকে গুডবাই
বলে চলে গেলে, কেন? হায় করমর্দন বিনাই
নিয়েছো বিদায়, যেন গূঢ় অভিমানে অকস্মাৎ।
না, অমন করে যেতে নেই নিভিয়ে পূর্ণিমা-রাত,
চেয়ার নিঝুম করে টলটলে গ্লাস ফেলে, ছাই,
ঠান্ডা না হতেই ত্র্যাশাক্ট্রেতে। চাই, তোমাকেই চাই,
বলে যে ব্যাকুল ডাকে, তারও হাতে রাখলে না হাত।এখন কোথায় তুমি ঝর্নাতলে নির্মোহ, একেলা
মুখ রাখো? কাদের আসরে খুব মেতে থাকো, বলো?
আমরা কজন আজো, তুমিহীন, বসি এখানেই-
তক্কে-গপ্পে গানে-পানে জমে ওঠে কিছু সন্ধ্যেবেলা।
হঠাৎ তোমাকে দেখি! ভাবি, যদি যাই, ছলোছলো
দুটি চোখে বলবে কি কেউ, না, অমন করে যেতে নেই? (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | ১
নব্বই-এর গণআন্দোলন, তার বিজয়, রূপান্তরিত করেছে আমাদের।
তোমাকে দেখলাম ‘জনতার জয়’ মঞ্চে কিছুক্ষণের জন্যে। ভিন্ন এক তুমি
এরই মধ্যে এক ফাঁকে কানে কানে বললে, ‘এই উৎসবে তোমাকে কিছু
উপহার দিতে মন চাইছে। ‘কী? আমার এই প্রশ্ন রৌদে ঝলসে ওঠে
শঙ্খচিলের ডানার মতো। তুমি কোনও উত্তর না দিয়ে ঠোঁটে হাসি খেলিয়ে
কোথায় উধাও। দিন যায়, রাত যায়; উৎসবের আনন্দ এখন ধুলোমাখা
জলরঙ। বর্বরদের পুনরুত্থানের কাল অনেকের আত্মত্যাগকে উপহাস করে
এসে গেল বলে। দিন যায়, দিন যায়। তোমার উপহাস আজও পাইনি।
প্রতিশ্রুতি আর কথা না রাখার মাঝখানে ভাসমান ক’জন শহীদের মুখ।
আমার না পাওয়ার তুচ্ছতায় লজ্জাবনত আমি ক্ষমা প্রার্থী তাঁদের কাছে, যাঁরা
রক্তের কালজয়ী আল্পনা এঁকে দিয়েছেন আমাদের আগামীর করোটি চিহ্নিত
বন্ধুর পথে।২
কত রাত ভালো ঘুম হয় না। চেয়ে চিন্তে আনা মুশকিল, চোখের পাতা
জোড়া লাগে না। বিছানায় শুয়ে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কখনও কখনও বিক্ষুব্ধ
মনে ক্যাপ্টেন আহারের মতো বহুক্ষণ পায়চারি জারি রাখি। দু’চোখে কেউ
যেন শুকনো মরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে দেয়। পানির ছিটা নয় নিদান। সমুদ্র উথাল
পাথাল করে ভেসে উঠলো অতিকায়, সাদা মবি ডিক? অনেকগুলো প্রেতমূর্তি
নাচতে থাকে ঘরময়। শব্দহীন , উদ্ভট সেই নাচ দেখি শুধু আমি। আরো কত
কিছু ঘটে নির্ঘুম ঘরে; কাউকে বললে, তুমি মেরে উড়িয়ে দেবে, যেন গাঁজাখুরি
গল্প। ভাবি, কবে রাত হবে কাবার? ভাবার আর কিছু থাকে না অনিদ্রার
ক্রুশকাঠে বিদ্ধাবস্থায়। কখনও তুমি আমাকে ঘুমোতে দাও না, কখনও না-
লেখা কবিতা আমার চুলের মুঠি ধরে টান দিয়ে সরায় ঘুমের পাতলা কুয়াশা।
অথচ তোমাদের দু’জনের কাউকেই কাছে পাই না সেসব অত্যাচারী মুহূর্তে।
কবিতা তবুও দয়াপরবশ হয়ে মাঝে-মধ্যে উঁকিঝুঁকি দেয়, তুমি একেবারে ধরা
ছোঁয়ার বাইরে। কতকাল এভাবে না ঘুমিয়ে কাটাতে হবে এই বয়েসী কবিকে?৩
চোখ বন্ধ করলেই সে দেখতে পেতো জঙ্গলের প্রান্তসীমার ঝিল, তৃষ্ণার্ত
হরিণের পাল। ওর হাত প্রসারিত হলেই হাতে চক্ষু ঘষতো রঙ বেরঙের
পাখি। এই মুহূর্তে তার দুটো চোখ রুদ্ধ জানালার মতো, হাতে প্রসারিত হবার
ক্ষমতা গায়েব, এমন নিস্পন্দ। এখন সে মৃত্যুর উপত্যকায়। মাটির নিচে
পোকামাকড় তাকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষায়। টেবিলে কিছু বইপত্তর ,
চায়ের শূন্য পেয়ালা, যার গায়ে কিটস্-এর বাড়ি, আর একটি উজাড় শিশি।
কবিতার খাতায় সারিবন্দি হরফ নয়, কাটাকুটির বিক্ষোভ মিছিল। ডাক্তার
ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিলেন আত্মহত্যাকে মুছে ফেলে, ঝুট ঝামেলার
ফাঁকফোকর বন্ধ করার উদ্দেশ্যে। মর্গে পাঠানো হবে না একে একে অনেকে
এসে জড়ো হয়েছে প্রান্তিক বাড়িতে কবিকে শেষবারের মতো এক ঝলক
দেখার জন্যে। কারও কারও বুক ডুকরানো; হু হু বিলাপের সঙ্গে লোবানের
ঘ্রাণ জড়ানো কোরানের আয়াতের ধ্বনি ঊর্ধগামী। রহস্যময়ী একজন কবির
বাড়ির দোরগোড়া থেকেই চলে গেল সকলের অগোচরে। গাছের একরাশ
পাতার প্রশ্ন, ‘কে তুমি নিষ্ঠুরতমা এভাবে ফিরে যাচ্ছো কবিকে এক নজর না
দেখেই?’ ‘একালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা আমি, যার জন্যে কবি মাথা কুটে মরেছে
রাতভর। আমার আগমনের আগেই তার অন্তর্ধান; সে প্রকৃত প্রতীক্ষা
শেখেনি,’ নির্বিকার কণ্ঠস্বর স্পর্শ করে রক্তজবার একগুচ্ছ সজীবপাতাকে, ঝুল
বারান্দাকে।৪
আজকাল চেনা রাস্তাগুলো বড় অচেনা মনে হয়। যে গলিতে ছিল আমার
নিত্যদিনের আসা-যাওয়া তার ভেতরে ঢুকলে একটা লম্বা সাপের সন্ধান পাই,
যাকে দেখিনি কোনওদিন। গলির মোড়ে বসতো যে দোকানদার সে
গরহাজির, ওর জায়গায় অন্য কেউ হিসেবনিকেশে ব্যস্ত, যার চুল তেল
চুকচুকে এবং ঢেউ খেলানো। বহুবার-পড়া কবিতার বইয়ের পঙ্ক্তিমালা
আমার পরিচয়ের গণ্ডি ছড়িয়ে ঝুঁকে থাকে অপরিচয়ের ভরসন্ধ্যায়। বস্তুত এই
ডামাডোলে দুঃসাধ্য কাউকে সঠিক শনাক্ত করা। একজনের মুখ অন্যজনের
মুখে মিশে যাচ্ছে অতি দ্রুত। অচেনা ঘরদোর, ভিডিও ক্লাব, ছাত্রাবাস,
সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সবচেয়ে বেশি অচেনা লাগে নিজেকে, এই অচেনা
আমি-কে নিয়ে কী করি?৫
মধ্যরাতে এক নেকড়ে ধর্ষণ করে স্তব্ধতাকে; চমকে ওঠে শহর, জেগে
থাকা কবির কলম থেমে যায়, ছিনতাইকারীদের আস্তানায় ঝাঁকুনি। চাঁদ
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মেঘের আঁচলে মুখ ঢাকে তাড়াতাড়ি; বিষণ্ন নারীর শাড়ি
থেকে খসে পড়ে লম্পটের রোমশ হাত। নিঃশব্দতার মাঝখানে নেকড়ের পথ
চলা টহলদার পুলিশের নাকের ডগার নিচে। নিমেষে সে পৌঁছে যায় শহরের
শেষপ্রান্তে। ছিনতাইবাজদের আখড়ায় পুনরায় মাতলামি, ইতরামি, লম্পটের
হাত ক্রিয়াশীল। বিনিদ্র কবি জানলা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মনোযোগী কবিতার
খাতায়, গড়ে উপমা, চিত্রকল্প। নিঃসঙ্গ বেগানা এক নেকড়ে প্রগাঢ় ছায়া রেখে
যায় নিশাকালীন রচনায়।৬
শরীরে ফাল্গুনের উজ্জ্বলতা নিয়ে তুমি ভোরবেলা জানালে, ‘আজ বসন্তের
প্রথম দিন। ইচ্ছে হয়, তোমাকে এক গাদা গাঁদা ফুল উপহার দিই। কেন তুমি
এই বিশেষ ফুলের নাম উচ্চারণ করলে? গাঁদা বললে আমার হরিদ্রাভ
পেলবতার কথা মনে পড়ে না, এমনই স্বভাব আমার, গাধা শব্দটি জিভের
ডগায় নাচতে শুরু করে, হয়ত মিলের প্ররোচনা। এ কথা তোমাকে
জানানোর সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনে হাসি ছড়িয়ে দিলে, বসন্ত দিনের রঙের
ফোয়ারা। সেই মুহূর্তে তোমার পরনে কি ছিল গাদা ফুল রঙের শাড়ি? ‘এমন
দিনে তোমাকে অন্য কিছু উপহার দেয়ার সাধ জাগে’; আমার উচ্চারিত
শব্দগুচ্ছের জবাবে তোমার ওষ্ঠ থেকে ঝরে, ‘বুঝেছি, আর কিছু বলার দরকার
নেই। কোনও কিছুই আমাদের দূরত্বের সীমা মুছে ফেলতে পারে না। আমরা
দু’জন দাঁড়িয়ে আছি দুই মেরুতে-তুমি উচ্ছ্বসিত বসন্তের রঙিন প্রান্তরে, আমি
প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহের মাঝখানে, চতুর্দিকে নেকড়ের বরফ ফাটানো চিৎকার।
তোমাদের বাসায় অতিথির ভিড়। টেলিফোনী সংলাপে পড়ে ছেদ। ঘরের
মেঝেতে গাঁদা ফুলের স্তূপ। কোথাকার এক গর্দভ দার্শনিক ভঙ্গিতে এসে
তড়িঘড়ি চুমো খেতে শুরু করে ফুলগুলোকে, অনন্ত তার চিবিয়ে খাবার পালা।
গাধার আচরণ আমাকে বিস্ময়ের ওপারে দাঁড় করিয়ে রাখে, বলা যাবে না।৭
তোমাকেই উত্তমর্ণ বলে জানি। তোমার টুকরো টুকরো কথা আমার
কবিতার খাতাকে মুখর করে তোলে। যখন তুমি সামান্য কোনও কথা বলো
আমাকে-এই ধরো, ‘আজ ভোরবেলার মুহূর্তগুলো চমৎকার’ কিংবা ‘কাল তুমি
কোথায় ছিলে সন্ধ্যাবেলা’, তখন কবিতার পঙ্ক্তি জ্বলে ওঠে অবসাদের
অন্ধকারে। বারান্দায় তোমার দাঁড়িয়ে থাকা সৃজনশীলতার খরায় আনে প্রবল
বর্ষণ। তোমার চকিত স্পর্শ আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় এমন কোনো কবিতা,
যা আমার মৃত্যুর পরেও যুবক-যুবতীরা পড়বে মুগ্ধাবেশে। জানতেও পারো না
আমি কীভাবে ক্রমাগত ঋণী চলেছি তোমার কাছে।৮
যখন গোলাপ মাটিতে শুকনো পাপড়ির জটলা, তখন কি আমার নিজের
মৃত্যুর কথা মনে পড়ে? আমার বয়স দ্রুতগামী খরগোশ, অনিবার্য মৃত্যুর দিকে
এগিয়ে যাওয়া। তবু এখন, এই মুহূর্তে বেঁচে আছি, পড়ছি মনের মতো বই,
ভাবতে পারছি তার কথা, যে আমাকে হাত ধরে নিয়ে যায় স্বর্গপথে; ভাবতে
পারছি ফেরেশতাগণ জ্যোৎস্নাপ্লাবিত কণ্ঠে আবৃত্তি করেন আমার কবিতা,
বেঁচে আছি বলেই কান পেতে শুনি সমাজ বদলের দূরাগত ঘণ্টাধ্বনি; আমার
অপন হৃদয় বারবার দুলে ওঠে প্রিয়তমার চোখের চাওয়ায়, দিনরাত্রি হয়ে যায়
গুণীর তান। আমার সদ্যমৃত অনুজ কোনও কোনও মধ্যরাতে দাঁড়িয়ে জেমস
ডিনের ধরনে দরজায় হাত রেখে, যখন লিখি টেবিলে ঝুঁকে, সে পেছন থেকে
চোখ বুলায় আমার পঙ্ক্তিমালায়। আমি তাকে কিছুতেই বলতে পারি না, ‘বস
এখানে আমার পাশে’, অথবা ‘চলে যা’, এই নিষ্ঠুরতাও উচ্চারিত হয় না
মধ্যরাতে। দৃষ্টিভ্রম আমাকে পীড়িত করে। কে যেন দরজা ঠেলে ঘন ঘন ঘরে
ঢোকার জন্যে। মৃত্যু? হ্যাঁ, মৃত্যু প্রত্যহ তার ঠাণ্ডা, বিশীর্ণ, পাথুরে আঙ্গুল দিয়ে
ছিঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে আমাকে। তার কোনও ভব্যতা, সমাজ সচেতনতা কিংবা
বিবেচনাবোধ নেই। (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | উজ্জ্বল তরুণ তুমি দিয়ো না সর্বদা নিষ্ঠীবন,
বিদ্রূপের বাছা বাছা তীর ছুঁড়ে তোমার সম্মুখে
কম্পমান কাকতাড়ুয়ার দিকে। তরুণ, একদা
তারও ছিল, যা তোমার আজকাল বন্দনীয় সাজ।
চারটি দশক প্রেমিকার ওষ্ঠ ছিল চুম্বনের প্রতীক্ষায়,
যখন তখন সে-ও আঙুলের ডগায় ফোটাতো
চেষ্টাহীন নক্ষত্রের ফুল, মাটি খুঁড়ে জাগিয়েছে
প্রস্রবণ, অলৌকিক দ্রাক্ষা রসে ভেসে গেছে তারবুক বার বার আর ফসল তোলার গানে সে-ও
হ’য়ে উঠেছিল ক্রমে কিন্নরের যোগ্য প্রতিযোগী।
দ্রোহে তার হয়েছে চৌচির কত বিগ্রহের মুখ;
তরুণ, সদলবলে যাও যদি যেতে চাও তাকে
ফেলে রেখে বিরানায় ভিন্ন মৃগয়ায়। অতঃপর
ভুলেও কোরো না দাহ তার কোনো কুশপুত্তলিকা। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | ‘এমন বিমর্ষ কেন তুমি’, আমাকে সওয়াল করে
আমার ঘরের বাতি। জানলার পর্দা কাঁপা কাঁপা
স্বরে প্রশ্ন করে, ‘কবি তোমার নিষ্প্রভ চোখ দু’টি
এমন কাতর কেন আজ?’ বারান্দার বুলবুলি
বলে, ‘কোন্ কাঁটা এসে তোমার হৃদয় অবেলায়
এমন জখম করে?’ ফ্লাওয়ার ভাসের ফুলগুলি
প্রশ্নাকুল, ‘কোন্ কীট তোমার অন্তর কুরে কুরে
খাচ্ছে আজ? আমার লেখার খাতা বড়ই নিশ্চুপ।এসব প্রশ্নের আমি কী দেবো জবাব? বলব কি
একজন নারী, যে আমার দয়িতা, না বুঝে এই
ছন্নছাড়া বেঢপ আমাকে নিজে খুব কষ্ট পেয়ে
যন্ত্রণার ক্রূর তটে করেছে নিক্ষেপ তার প্রিয়
কবিকে? বিষণ্ন কেন আমি আজ নিজেই বুঝি না;
বুক ঠেলে কান্না আসতে চায়, কিন্তু কাঁদতে পারি না। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | তোমরা আমাকে বুঝি পোষমানা পশু
বানিয়ে রাখতে চাও খাঁচার ভেতর? এ জীবনে
যা কিছু গৌরবময় তার প্রতি উদাসীন নিত্য
খুঁটব আহার্য আর নিজেরই পুরীষে রাত্রিদিন
দেব গড়াগড়ি, মাছি বসবে শরীরে
যখন তখন, তাড়াবার ইচ্ছাটুকু নির্বাপিত,
জমবে আত্মায় শুধু আলস্যের ক্লেদ-
এই তো তোমরা চাও, হে আমার প্রাণের স্বজন।আমার স্বপ্নের চারপাশে ছারপোকা ঘোরে, মৃত
নক্ষত্রের ছায়া ফিসফিসে কণ্ঠস্বরে কথা বলে
কবিতার মেরুন খাতার কানে কানে। সেই কবে
কাঁদতে ভুলেছি বলে ফাঁকা দৃষ্টি মেলে
চেয়ে থাকি সবুজ ডোবায়
নিজের মুখের দিকে। একটি বিষণ্ন পাখি কেঁদে উড়ে
যায়।আমার বুকের ডান দিক থেকে বারুদের ঝাঁ ঝাঁ
গন্ধ ঝরে যায়,
আমার দু’চোখে রক্তছিটা শব্দহীন কলরব করে আর
করতলে দুঃস্বপ্নের কাকের করোটি
নেচে ওঠে বারে বারে। কোকিলের গানের আশায়
কান পাতি, ঘাতকের পদধ্বনি মেরুদণ্ডে হিম মেখে দেয়।আত্যস্ত কঠিন আজ প্রকৃত কবির মতো কণ্ঠে
অসত্যের কোলাহল থামিয়ে সত্যের
পূর্ণিমায় চতুর্দিক উদ্ভাসিত করা। ক্ষিপ্র নেকড়ের কাছে
সিংহের চকিত আত্মসমর্পণ অতি
শোচনীয় দৃশ্য বটে। রক্তে নেই তারাবাতি-দ্যুতি,
তাৎপর্যের আভা ক্রমাগত বহু দূরে সরে যায়।
তোমরা দেখছ যাকে এমন বিপন্ন গোধূলিতে,
সে-তো আমি নয়।
কোথাও সোনালী ঘন্টা বাজে, জাগরণ; খাঁচার ইস্পাতি
শিক
বেঁকে যায় একে একে, খুলে যায় দ্বার,
যেন সূর্যোদয়,
এবং শেকল খসে, ছটে যাই বর্শার মতোই
উদ্দাম, স্বাধীন; পায়ে মেঘ চুমো খায়,
নিরায় শিরায় ভোরবেলাকার রৌদ্র রং ময়ূরের নাচ।
ডানাঅলা কে বার্তাবাহক অগোচরে
আমার মুঠোয় কিছু স্বপ্ন গুঁজে দেয়। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | পরিবেশ ছিল দৃষ্টিনন্দন সেখানে, চারদিকে মোলায়েম
দীপ্তি ছিল ঘাস আর গাছগাছালির। যুবতীর
হাসির মতোই প্রস্ফুটিত ছিল ফুল। নিরিবিলি
একটি কুটির যেন একাকী তাপস মগ্ন ধ্যানে বহুকাল।কুটিরের দরজা জানালা বন্ধ সারাক্ষণ; কড়া নেড়ে নেড়ে
ক্লান্তি আর বিরক্তির গাঢ় ছায়া নিয়ে
ফিরে যায় ছায়ার মতোই অগণন পথচারী। এভাবেই
দিন যায়, রাত কাটে, নানা ঋতু এসে চলে যায়;
হায়, কত কাল লুপ্ত হয়, রাখে না হিসেব কেউ। সেই ঘর
প্রতীক্ষা-কাতর কোনও রূপসীর মতো
খাঁখা দৃষ্টি মেলে
পথের আরেক ধুধু সত্তা অবিরত হতে থাকে যেন।
অপরূপ সেই পরিবেশ কেবলি হারাতে থাকে
রূপ-বড় জীর্ণ শীর্ণ গাছ, মরা ঘাসের ফোঁপানি
চারদিকে, ফুল আর ফোটে না কোথাও
কিছুতেই, হাহাকার ছাড়া কোনও সুর নেই এখানে এখন।
কোনও এক নিশীথের প্রগাঢ় প্রহরে একজন শাদাসিধে
পুরুষের পদচ্ছাপ পড়তেই অমাবস্যা-রাতে আচানক
নিরুপম জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হয় বিরান এলাকা। সহজেই
খুলে যায় কুটিরের রুদ্ধ দ্বার, বেজে ওঠে জীবনের সুর। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | অকস্মাৎ সে-রাতে নতুন ক’রে পেলাম তোমাকে
হৃদয়ের খুব কাছে। প্রত্যাশা ছিল না,
তবু আমার ঘাটে ভিড়ল আশ্চর্য তরী এক
অপরূপ সম্ভার সমেত। শুধু বিস্ময়ে তাকাই নিষ্পলক
সারাক্ষণ, ফেরাতে পারি না দৃষ্টি কিছুতেই। তুমি,
তরণীর পরম ঐশ্বর্য, নেমে এলে ধীর,
গৌর পদক্ষেপে।কখন যে আমার পায়ের কাছে এসে বসলে সবার
অগোচরে, স্বপ্নবিষ্ট আমি
খেয়ালই করিনি; দেখি আমার উরুতে
স্থাপিত তোমার মুখ। তোমার অতল চোখ দু’টি
কখনো আংশিক খোলা, কখনো নিবিড় নিমীলিত।
মাঝে মাঝে
চোখ মেলে দেখছ আমাকে, যেন খোদ ভালোবাসা
তাকাচ্ছে আমার দিকে সম্পূর্ণ নতুন ক’রে গাঢ়
অনুরাগে, আমার দু’ হাতে
তোমার অতুলনীয় মুখ, বুঝি কোনো শায়েরের
অঞ্জলিতে অনুপম প্রস্ফুটিত রূঁপসী গজল।আকাশে ছিল কি চাঁদ? সপ্তর্ষিমগুল?
বলতো কী ক’রে বলি? আমি তো তোমাকে ছাড়া আর
কিছুই দেখি নি স্পষ্ট ভেতরে বাহিরে।
সৌন্দর্যের কসম, তোমাকে
এর আগে এমন সুন্দর আমি কখনো দেখি নি,
যদিও সৌন্দর্যে লগ্ন আমার সমুখে দাঁড়িয়েছ,
বসেছ ঘনিষ্ট হয়ে বহুদিন, বহু
মুহূর্ত কেটেছে আমাদের আলিঙ্গনে, ওষ্ঠের নিলনে। (তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | তুমি কি কলেজ স্ট্রিটে ঘুরছ এখন? নাকি নিউ
মার্কেটে করছ বেশ কেনাকাটা প্রিয় বান্ধবীর
সঙ্গে ঘুরে ঘুরে খর রোদে? কলকাতায় বড়ো ভিড়,
তোমার কি ভালো লাগে দম আটকানো কোনো ভিউ?এই যে এখানে তুমি নেই, এখন আমার কাছে
চিরচেনা এ শহর বড়ো জনশূন্য নিষ্প্রদীপ
মনে হয়, যেন ঢাকা আজ পরেনি কপালে টিপ
শোকে; ফুল নয়, অশ্রুবিন্দু ফুটে আছে সব গাছে।কোথাও যাবার নেই; সময় পাথর হয়ে চেপে
আছে বুকে, মাকড়সা জাল বোনে দু’চোখে আমার
ক্রমাগত, প্রায় ধৃতরাষ্ট্র হওয়ার আশঙ্কা আজ
তোমার অভাবে। খবরের কাগজে হৃদয় ছেপে
তোমারই বন্দনা গাই; এলো বুঝি পাতালে নামার
সময়, তোমার প্রতীক্ষায় মগ্ন থাকাটাই কাজ। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | সুন্দরবনের রোদ-চকচকে হিরণ পয়েন্টে যে হরিণী
জলপানে মগ্ন সেই কবে, পুনরায়
যেন সে বিদ্যচ্চমক কবিতার রাজধানীতে সকালবেলা;
এ-ও এক খেলা তার শহরকে জড়িয়ে শরীরে।অনির্বচনীয় রূপ নিয়ে একগা হরিণী যায়
কবি সম্মেলনে হেঁটে যায় সাবলীল, মহিমার
ছটা তার সত্তা থেকে বিচ্ছুরিত; হঠাৎ উধাও।
এদিক ওদিক খুঁজি, বুক চিরে ট্রেন দূরগামী, চতুর্দিকে
সুচতুর শিকারীর ফাঁদ পাতে বন্দুকের ট্রিগারে আঙুল
রেখে ঘোরে ইতস্ততঃ। হরিণীর কোথায় তেমন বর্ম যাতে
সহজে পিছলে যাবে ঝাঁক গুলী?
ওদের সকল তাক যাক ফস্কে যাক।
অকস্মাৎ হরিণীকে দেখি উত্তাপ উপেক্ষা ক’রে
চলেছে ব্যানার ছুঁয়ে কবির মিছিলে, গায়ে তার
বাংলার মখমলী গাঢ় সবুজিমা, এমন সুন্দর টিপ
কোথায় সে পেলো? কাঁচপোকা
ব’সে আছে মসৃণ কপালে?
গলায় নিবিড় লগ্ন নক্ষত্রের মালা,
দু’চোখে বিলীয়মান স্বপ্নের অস্পষ্ট দীর্ঘশ্বাস,
যেন সে লাফিয়ে ওঠা শিখা, প্রতিবাদে
স্পন্দিত সৌন্দর্য ক্ষণে ক্ষণে,
চম্কে তাকায় রৌদ্রে স্নাতা। অদূরে দাঁড়িয়ে দেখি
তাকে, দেখে সে-ও, পরস্পর চোখাচোখি, বুঝি এক
মধুর মালিন্যহীন গোপন দাঁতাত।জানি আজ প্রকৃতির অভিষেক হবে তার হাতে
আবার নতুন ক’রে। চলায় ছিলো না দ্বিধা, পথে
পুলিশের ভ্যান,
তবু দৃক্পাতহীন চলেছি সম্মুখে, তার গায়ে
আঁচড় লাগলে কোনো আমার হৃদয়
বিষম আহত হবে, অশ্রু হ’য়ে ঝরবে শোণিত
সারাক্ষণ, চাই না কখনো তার সৌন্দর্য ভুলেও
অন্ধকার মর্গে যাক। সে থাকুক বেঁচে রোদবৃষ্টি বুকে নিয়ে
দীর্ঘজীবী কবিতার মতো সজীব, নিটোল। নিত্যদিন
আমার জীবদ্দশায় হোক সে অধিক বন্দনীয়।হরিণী অক্ষরবৃত্তে এগোয় মঞ্চের দিকে, মাইক্রোফোনের
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ে। শব্দাবলী থেকে
যন্ত্রনা গিয়েছে ঝ’রে, পথকষ্ট মুছে গেছে, লুপ্ত স্বেদমুক্তো;
কবিতা পাঠের কালে নিজেই কবিতা হ’য়ে জ্বলে
সুবিশাল সমাবেশে পিন-পড়া স্তব্ধতায়। হ্রদের পানির
মতো স্বচ্ছ বাক্য রাত্তিরে লতিয়ে ওঠে, আখেরে চকিতে
কখন যে নেমে আসে, চ’লে যায়, ‘হরিণী-কবিতা’
ব’লে আর্তনাদ করি, তাকায় না ফিরে। আমি কুকুরের মতো
কী ব্যাকুল চুমো খাই চিহ্নহীন পদাচিহ্নে তার। একা-একা
যতি, ছেদ, পর্বসহ তাকেই মুখস্থ করা নিয়তি আমার।
কে ডাকে আমাকে মধ্যরাতে? কে এক অকালমৃত কবি
লেখার টেবিল থেকে ওঠে এস যেন
শয্যা ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে ডেকে নেন কাছে।মুখ তাঁর, মনে পড়ে, ‘ক্লেদজ কুসুম’ গ্রন্থটির
অন্তর্গত; ব্যথিত ফ্যাকাশে। স্থির হও, বসো তুমি
এখানে চেয়ারে, লেখো একটি সনেট
নিষাদে, নির্বেদে ভরপুর। যাকে চাও
সে হরিণী নাকি অমল কবিতা, সে তোমার
কোনোদিন হবে কিনা ভেবে কষ্টে বিবর্ণ হয়ো না।
আমার মতোই, হাতে তুলে নাও এখুনি কলম;
থাকবো না বেশিক্ষণ, ঢুকবো কফিনে পুনরায়,
‘বিদায়, বিদায়’ ব’লে তিনি ঘন কুয়াশায় ট’লে ট’লে
মিশে যান। নির্ঘুম, স্তম্ভিত ব’সে থাকি
কিছুক্ষণ বড় একা। কবিতা-হরিণী ধরা দিয়ে চ’লে যায়। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | বাইরে তাকিয়ে দেখি
রৌদ্রবিহীন সকাল,
আকাশ এঁটো পানিময় বাসন।
হঠাৎ বেজে উঠলো টেলিফোন, তোমার
কণ্ঠস্বর নিমেষে
আমার মনের ভেতর ছড়িয়ে দিলো
একরাশ রোদ। রিসিভার ক্রেডলে
রাখার আগে
তুমি বললে, ‘ভালো থেকো।দিনকাল যা পড়েছে
ভালো থাকা দায়। তবু
‘ভালো থেকো’ এই শব্দযুগল আমার
চোখের সামনে মেলে দিলো
কিছু সুশ্রী ছবি। পালটে গেল একালবেলার
মুখ, আর সেই মুহূর্তে
জানালার বাইরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে ভাবলাম,
নিজের জন্যে না হলেও
কারোর জন্যে আমার ভালো থাকা দরকার।
কিন্তু ব্যাপার হলো এই,
ভালো থাকতে গিয়ে অনেক বাধার দেয়াল গুঁড়িয়ে
আমি এখন বিশাল এক অগ্নিকুণ্ডে
কী প্রবল ঝাঁপিয়ে পড়েছি। (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | মনে হয়, কতকাল বাইরে যাইনি কতকাল,
যেন হিমযুগে রয়ে গেছি, অন্ধকার বাস করে
দীর্ঘকাল বাস করে, হৃদয় কেমন কৃষ্ণকায়
তুষারের মতো হয়ে গেছে। লতাগুল্ম কিছু নেই
চুতুষ্পার্শ্বে, বুজে থাকা চোখ বড় বেশি ঢাকা রুক্ষ
পাথুরের কণায়, ঘোড়া কোথায় যে উধাও, একটি
শীতল গুহায় আমি ভীষণ আটকা পড়ে গেছি।
আমাকে পাবে কি খুঁজে কখনো উদ্ধারকারী দল?এখন পাতিনা আর কান কোনো শব্দের উদ্দেশে,
পাছে প্রতারিত হই। হাতে হাত ঘষি বারংবার
জ্বালানিবিহীন, ক্রমাগত নীল-হয়ে-আসা ওষ্ঠে
নাচে স্বপ্ন, নাচে স্মৃতি; জন্ম-জন্মান্তর কম্পমান
দৃষ্টিপথে। যদি কেউ আসে এখানে, দেখবে একা
বিশীর্ণ কংকাল আর দেয়ালে শিল্পের অপচয়। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | চিকিৎসক এবং রোগী মুখোমুখি, যেন দুই গ্রহ। চিকিৎসক
রোগীর দিকে এক ফালি হাসি পেশ করে জানতে চাইলেন,
কি অসুবিধা খুঁড়ছে তাকে। ঘুসঘুসে জ্বর হচ্ছে কিনা, কিংবা
শরীরের কোন অংশ যন্ত্রণাকাতর কতটুকু, হজম হচ্ছে তো
ঠিক? চিকিৎসক রোগীর রক্তচাপ পরীক্ষা করে দেখলেন,
স্বাভাবিক। সব কিছুই তো ঠিকঠাক আপনার। কোথাও কোনও
উপসর্গ, গলদ লক্ষ গোচর হচ্ছে না। খামোকাই বিচলিত
আপনি। এবার নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি যেতে পারেন।রোগী চিকিৎসকের কথা শুনে তাজ্জব! কোথাও ভুল
করেন নি তো তিনি? রোগী চিকিৎসককে বললেন, চোখ দুটি
বুজলেই দৃষ্টিপথে হাজির হয় ভয়ংকর বিকৃত কয়েকটি মুখ।
কখনও একজন ডাকাবুকো লোক ছুরি চালাচ্ছে এক তরুণের
গলায় আমারই সামনে, সন্ত্রাসীরা সুশীল গেরস্তের ঘরবাড়ি
দেদার পোড়াচ্ছে, যত্রতত্র সম্ভ্রম লুটছে তরুণীদের। ধর্ষিতা
যুবতীরা গ্লানিতে ডুবে মাতে আত্মহননে। চকচকে
ছোরা, উপরন্তু রক্ষীরা সন্ত্রাসে দড়।
প্লীজ ডাক্তার আমাকে বাঁচান। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | কিছুই পারো না ধরে রাখতে কখনো, ঝরে যায়-
হাত থেকে গোলাপ টগর, চিঠি, ঝুঁটি কাকাতুয়া,
কবিতা লেখার নীল পোয়াতী প্রহর
নিরিবিলি ঝরে যায় শুধু।
এক ডিসেম্বরে পাওয়া নামঙ্কিত আলৌকিক একটি রুমাল
হারিয়ে ফেলেছো তুমি অন্য ডিসেম্বরে।
এমন শিথিল মুঠি যদি, তবে ঘোর অবেলায়
কী করে ধরবে বলো সারবন্দি ঝড়ক্ষুব্ধ খুঁটি?প্রতিবাদ করবো কি? স্বীকার করাই ভালো, আমি
ব্যর্থতার আতিথ্য গ্রহণ করে অম্ল
ঢেকুর তুলছি ক্রমাগত,
তবু কলমের নিবটিকে সোনারুর মতো খুব ঘঁষে ঘঁষে
একটি নিজস্ব অলংকার বানিয়েছি চমৎকার। বারংবার
হৃদয় কুপিয়ে তুলে আনি গোপন উদ্ভিদ কিছু,
অথচ খরখরে কাগজের কাছে কতবার পরাস্ত এ হাত।কী এক সময় এল বিশ্বাময়, নির্ভরযোগ্যতা নেই কোথাও কিছুর।
ব্যানারে ফেস্টুনে মিথ্যা চেঁচাচ্ছে মাতাল
আদিবাসীদের মতো। মুদ্রাক্ষর, নাম ধাম লোকালয়, কবির হৃদয়
সবকিছু মিথ্যা, ভয়ানক মিথ্যা মনে হয় আর
অতিশয় ঘৃণ্য ঠেকে বসবাস পৃথিবীতে আজ।
অন্যদের কাছ থেকে, এমনকি নিজের নিকট
থেকেও পালাতে চায় দিগ্ধিদিক দেশে দেশে বিপন্ন মানুষ।
বসে থাকি অস্তরাগে ভীষণ একাকী, চক্ষুদ্বয় নিবু নিবু,
কেমন নিঃস্পন্দ শিরোপুঞ্জ মাঝে-সাঝে অলৌকিক গুঞ্জরণে
নড়ে চড়ে উঠি আর ক্ষণিকের জন্যে তড়াক লাফিয়ে ওঠে
হরিণ শিশুর মতো খুশি।
কখনো আবার বড় লোনা,
খর ঢেউ ভেঙে পড়ে আমার শরীরে
এবং পায়ের নিচে পড়ে থাকে অনেক গাংচিল, ভেজা, মৃত;
ভারি জব্দ করে ক্রুর হিসহিস জলে চাবুক।
ভালোমন্দ কিছু অভিজ্ঞতা আছে আমারও অকূল সমুদ্রের,
আমিও দুলেছি ঢেউশীর্ষে বহুকাল,
দেখেছি দু’চোখ ভরে উথাল পাথাল কত মাছ,
এবং ডাগর চন্দ্রোদয়।
আহারের মতো ছুটে চলেছি সফেদ
প্রাণীটির প্রতি আজো বিরতিহীন।
পরে কোনোদিন তীরে পৌঁছে সঙ্গীহীন ইশমায়েল বলবে
অবসন্ন, সিক্ত স্বরে ট্র্যাজিক কাহিনী আমাদের। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | বহুদিন পর সন্ধ্যা রাতে আবার সেখানে। গেট পেরুতেই আমার
শরীরের অনেক দিনের আলো-ছায়া গান হয়ে যায় বাগানটিকে দেখি
বাড়িটার মুখ থমথমে। আমার দীর্ঘ না-আসা ওর অবয়বে ঝুলিয়ে
দিয়েছে অভিমানের মেঘ, যেন এখনই বইবে জলধারা। ওর গায়ে কতবারই না
চোখ বুলিয়েছি সস্নেহে, করেছি সানুরাগ করমর্দন। কতদিন তার
বুকের এক পাশে নিবিড় বসে স্বপ্নের উপত্যকায় ভ্রমণের বর্ণিল অভিজ্ঞতা
সঞ্চয়ের অবকাশ হয়েছে আমার। মুহূর্তগুলো এক মুঠো মুক্তো হয়ে উঠত।
বাগানের সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠতা অধিক লতিয়ে ওঠে। মনে পড়ে,
সন্ধ্যামালতী, জিনিয়া আর রঙ্গনের উৎসুক দৃষ্টি কেমন নিবদ্ধ থাকত
আমার দিকে। কখনও কখনও চোখ ফেরাতে পারতাম না, আহ এমনই
বাহার। এক জ্যোৎস্নারাতে স্বর্ণচাঁপ গাছটিকে মনে হয়েছিল ছায়াপথ
বেয়ে নেমে-আসা এক অপ্সরা। গাছগুলোর পুঞ্জ পুঞ্জ গভীর সবুজ কবিতা
লেখার আগের মুহূর্তরূপে মন-মেঘে মেশে। যার স্নেহার্দ্র
পরিচর্যার যৌবনের গৌরবদীপ্ত এ বাগান, তার হাত ধরেই এখানে
প্রথম প্রবেশ আমার। এই উদ্যান তার অন্তর্লোকে কখনও সৃষ্টি করে
সপ্তসুর, কখনও জাগায় রঙধনু, কখনও-বা জ্যোৎস্না-প্লাবনে ভাসে
হৃদয়ের একূল ওকূল। আমি সর্বস্ব পণ করে সেই প্লাবনে
ভাসিয়েছি তরী। বাড়িটার মুখ থেকে অভিমানের মেঘ অপসারিত;
ওর ঠোঁটে ঘন ঘন হাসির ঝিলিক আর বাগান পুষ্পল তাকিয়ে
বলে, ‘কবি, আবার এসো আমাদের এই সান্ধ্য সভায়। প্রতীক্ষায়
থাকব।‘ আমি হাতে নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে পথ চলি, পথের ধুলায়
স্বপ্নিল হরফে লেখা শুভেচ্ছাবাণী। আর মালঞ্চের যিনি অধিশ্বরী
তার হৃদয়ের গান, মননের আভা আমাকে পথ দেখায় সামনের
দিকে। মুঠোভরা নক্ষত্র মদিরার পাত্র হয়ে আমার ওষ্ঠ স্পর্শ
করে নিমগ্নতা বুলিয়ে, আমি প্রবেশ করি দিগন্ত-ছেঁড়া ভিন্ন ভুবনে। (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | এক্ষুণি বলে ফেলা দরকার, নইলে খুব বেশি
দেরি হয়ে যাবে। সত্যাসত্য নিয়ে ঝাক্কিঝামেলা,
তর্কাতর্কি মূলতুবি রেখে
বোধোদয়ের বাগান থেকে
পরগাছাগুলোকে একটু হাত লাগিয়ে
উপড়ে ফেলা যাক
সময় আমাকে তাড়া করে। গাছে লটকানো
হিস্পানি গিটার জপায়, স্বীকারোক্তি চাই।এতদিন যে তাসের ঘর তৈরি হয়েছিল
আমার মনের খেয়ালে, বৈরী হাওয়ার ফুৎকারে
তা লহমায় ভূমিসাৎ। অগ্নিবলয়ের এপার থেকে
দেখলাম, একটা জতুগৃহ গলে গলে
মাটির সঙ্গে মিশে গেল। সেই
অগ্নিকাণ্ডের তাণ্ডবমুক্ত একটি পাথরে
তোমার নাম উৎকীর্ণ করতে গিয়ে বানানের
বিসমিল্লায় গলদ, চৌদিকে হাহা হিহি।
করজোড়ে তোমার কাছে মাফ চাই। কবুল করি, এতদিন
তোমাকে নিয়ে যে ছাইভস্ম লিখেছি বার বার, তার
কোনো মাথামুণ্ডু নেই, কোনো বুনিয়াদই নেই।
মিথ্যার নকল নক্ষত্রখচিত কাঁচুলি নিয়ে খেলা করাই
আমার দ্বিতীয় স্বভাব, এতদিনে তোমার
অজানা থাকার কথা নয়,
তোমার যে হাত কখনো স্পর্শ করার
সুযোগ কিংবা সাহস আমার হয়নি,
তোমার যে ঠোঁট কখনো যুক্ত হয় নি আমার ওষ্ঠে,
তাদের কলুষিত করেছে আমার মিথ্যা বয়ান।আমার এমনই বসিব, কল্পনা আমাকে ফুসলিয়ে
তিলকে তাল বানিয়ে নিয়েছে। ভালোবাসার
কাঙাল আমি, তোমার মধুর সৌজন্যকে
তরজমা করে নিয়েছি প্রেমে এবং আমার বেহুদা
বেশরম কলম, অতিরঞ্জনে বেজায় দড়, তোমাকে
পর্বে পর্বে বিব্রত করেছে। এই মুহূর্তে ওর গালে চড়
কষাতে ইচ্ছে করেছে; কেননা সে ছন্নছাড়া,
অবাস্তব স্তবকের রচয়িতা।
আমার কলমের বেহায়াপনায়, রংবাজিতে
আমি নিজেই তাজ্জব।
তোমাকে প্রবাল সিঁড়ি থেকে নামিয়ে আমার
কল্পনাজীবী লেখনী আমার বাঁ পাশে
বসিয়ে দিয়েছে জ্যোৎস্নাধোয়া দোলনায়।
তুমি আমার আলিঙ্গনে
ছিপছিপে নৌকোর দোলা, এরকম একটা ছবি
ফোটে তার কয়েকটি আঁচড়ে।তুমি আমাকে কখনো এমন কিছুই বলোনি,
যাতে মনে হতে পারে তোমার হৃদয়ে
আমার উদ্দেশে ছিল ভালোবাসার বিচ্ছুরণ।
রৌদ্র-জ্যোৎস্না, পানিতে টইটুম্বুর দীঘি
আর হাওয়ায় স্পন্দিত গাছের পাতার ঝিলিমিলি
যা কিছু জপিয়েছে আমাকে
তাকেই তোমার উচ্চারণ ঠাউরে
আমি খুশিতে ডগমগ
যদি তুমি ভুলে যাও আমার বলপেনের
অপরিণামদর্শী উচ্ছলতা, তাহলে আমার
অপরাধের বিষবৃক্ষ উৎপাটিত শেকড়বাকড় সমেত।
যদি বলো, এই বেল্লিককে ছুঁড়ে ফেলে দিই
শ্মশানঘাটের দাউ দাউ চিতায়
অথবা মাছের মড়ক লাগা বুড়িগঙ্গায়।এতকাল আমার যে অক্ষরমালা
তোমার গলায় পরিয়েছি বলে ঢি ঢি
পড়ে গ্যাছে পাড়ায় পাড়ায়, আসলে তার
একটি মুক্তোও সাচ্চা নয়,
এটা কেউ একবারও ভেবে দেখলে না।
তুমি ছাড়া কে ওদের বলে দেবে যে, যদি কেউ
জলাশয় ভেবে মরীচিকার পেছনে ছুটে মরে দিশেহারা
তবে ভ্রষ্ট পথিকের আর্তনাদের জন্যে
মৃগতৃষ্ণিতাকে দায়ী করা অন্যায়।
কী আনন্দ পায় ওরা বেবুনিয়াদ ছায়ার মহল বানিয়ে?যারা আমাকে সাতবার
মাটিতে পুঁতে ফেটে পড়ে অট্রহাসিতে
আর গায়েব লাঠিসোটা নিয়ে
লড়াই করে আমার ছায়ার সঙ্গে দিনভর, রাতভর,
আমার হাতে স্বরচিত মিথ্যার কাঁচুলি দেখেই তারা ঠাউরে
নিয়েছে সত্যের নগ্নতার সঙ্গে আমার মাঝামাখি।আমার এই স্বীকারোক্তির পর
কেউ আর তোমাকে দেখে মুখ টিপে হাসবে না,
বিব্রত হবে না তুমি
আমার লজ্জা আর পাপ উন্মোচন করে
আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে
আমি তোমাদের সবাইকে মুক্তি দিলাম।
মনগড়া ভুল স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে থেকে
চড়ায় মুখ থুবড়ে রক্ত ভেজা বুকে
কীভাবে বেঁচে থাকা যায়
ভালোবাসার চৌচির খরায়, এখন থেকে
এটাই আমার অনুশীলন।হঠাৎ লেখার টেবিলে আমার কলম
স্যামসনের মতো পেশী ফুলিয়ে, ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে
গরগরে স্বরে করলো উচ্চারণ-
‘আমাকে মিথ্যেবাদী আখ্যা দিয়ে
কার কার মুখ বন্ধ করতে চাও, কবি?’ (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | অকস্মাৎ অন্ধকারে একটি পুরনো কোঠাবাড়ি
তাকালো আমার প্রতি চোখ মেলে। বাড়িটার ঘ্রাণ
বাড়ে ক্রমাগত, দেখি বর্ষিয়সী নারী,
পরনে নিঝুম শাড়ি, অত্যন্ত সফেদ, যেন অই আসমান
দিয়েছে মহিমা তার সমগ্র সত্তায়। তাকে চিনি
মনে হয়, তিনি মাতামহী আমার এবং যাকে
আপা বলে ডাকতাম শৈশবে, কৈশোরে। মনে হতো চিরদিনই
থাকবেন তিনি তার কোঠাবাড়ি ভালোবেসে আর আমার ব্যাকুল ডাকে
দেবেন সানন্দ সাড়া যখন তখন। অন্ধকারে
এই তো দেখছি তিনি জ্বেলেছেন হ্যারিকেন ঘরে, আলো যার
কল্যাণের প্রতিবাদ অশুভের বিরুদ্ধে সর্বদা। বারে বারে
আমার মাতুল সেই কবে মদে চুর হয়ে ফিরে এলে হ্যারিকেন তাঁর
নিশ্চুপ বেরিয়ে আসতো আঙিনায় সন্তানের হাত ধরে তিনি
উঠোন পেরিয়ে ঘরে রাত্রিময় যেতেন ঔদাস্যে ভরপুর।
দিতেন শুইয়ে তাকে, নিতেন জুতোর পাটি খুলে, আমি ঋণী
চিরকাল এ দৃশ্যের কাছে। সুন্দরের স্পর্শে বাজে অস্তিত্বের সুর।রাত্রি বড় ভয়ংকর মনে হয় আজকাল, ভীষণ টলছে মাথা, সারা
গায়ে ভুর ভুর করে গন্ধ প্রায় প্রতিরাত, মধ্যরাতে বুঝি
মেঘে মেঘে হেঁটে যাই, খিস্তি করি নক্ষত্রের সাথে। দিশেহারা,
বেজায় বিহ্বল আমি আর্ত অন্ধকারে। কী-যে খুঁজি
এ বিজনে এলোমেলো ভীষণ একলা আর কেমন অচেনা
লাগে প্রতিবেশ; আপা, তুমি হ্যারিকেন দোলাবে না? (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | সে জানে বিচার হবে তার। কেন? সে-কথা অজ্ঞাত
জানে না কী তার অপরাধ। এ কেমন্ কাঠগড়া,
সাক্ষী সাবুদও বা কী রকম? বিচারক অনাগত, শুধু
চৌদিকে বোলেল্লা হল্লা। কেউ কেউ চোখের ঠোকর
মারে তাকে, কেউ কেউ ইতর ভাষায় কী-যে বলে,
মলিন ছাতার বাট কিংবা ছড়ি দিয়ে মাঝে-মধ্যে
কেউ বা খোঁচায়। ধন্দে করুণ সে, অসহায় আজভুলেছে নিজের নামধাম। অকস্মাৎ ফিসফাস,
হয়তো বা এসেছেন তিনি, মানে বিচারক। সে-ও
চালায় নিস্পৃহ দৃষ্টি, তার রুক্ষ চুল, চার দিন
না-কামানো দাড়ি, শিরদাঁড়া বেয়ে মুহূর্ত গড়ায়।না, ধর্মাবতার আসেন নি। পুনরায় হট্রগোলা,
অট্রহাসি, একজন তাকে ক্ষিপ্র চিমটি কেটে দূরে
সরে যায়, অন্যজন নিপুণ ধাক্কায়
হঠাৎ মাটিতে ফেলে ছোঁড়ে লাথি, যেন সে টিনের
কৌটো; কেউ কর্কশ মধ্যাহ্নে তার মুখের নিকট
টলটলে জলভরা গ্লাশ নিয়ে পর মুহূর্তেই
ঝটিতি সরিয়ে নেয় হাত।তৃষ্ণা বাড়ে আরো, দ্যাখে, মৎস কন্যা সমস্ত শরীরে
অভ্রের মতন জলকণা নিয়ে অদূরে দাঁড়ানো
এ অশ্লীল ভিড়ের মধ্যেই।
দ্যাখে কযেকটি হাড়, হয়তোবা নাবিকের, নেচে
নেচে আসে, দ্যাখে মৃত ভস্ম ঝেড়ে ফিনিক্স আবার
জেগে ওঠে। বিচারক অনাগত। অধৈর্য, অশান্ত
দর্শকেরা মেতে ওঠে অলৌকিক দাঁড়িপাল্লা হাতে,
দেয় রায়-তাকে শত কুটি করে রক্ত গোধূলিতে
নদীতে ভাসাতে হবে। তার শরীরের টুকরোগুলো,
দেখলো সবাই, দ্রুত হয়ে গেলো এক শো গোলাপ।‘এমন মামলা ঘটে, এতে কিছু নতুনত্ব নেই;
ব’লে তারা গোলাপের পাপড়ি
কুটি কুটি ছিড়ে ফের ওড়ালো অনেক ধূলো-ধোঁয়া। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | যেয়ো না, দাঁড়াও ভাই। খানিক দাঁড়ালে,
আশা করি, বড় বেশি ক্ষতি
হবে না তোমার। দেখছ তো এই আমি
একলা পথের ধারে পড়ে আছি বড় অসহায়কখনও ইঙ্গিতে, কখনও-বা উঁচিয়ে গলার স্বর
পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণে লুব্ধ হয়ে পড়ি
বারবার জ্ঞাতসারে, কখনও আজান্তে। অকস্মাৎ
পায়ের পুরনো ক্ষত বেদনা-কাতর হয়ে ওঠে।হঠাৎ পায়ের ক্ষত আমার দৃষ্টিতে কেন যেন
স্বর্গের পুষ্পের মতো ফুটে ওঠে। তা হ’লে কি
আমি উন্মাদের অবিকল ছায়ারূপে প্রতিভাত
বর্তমানে? বেলা শেষ হলে ফের খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যাব গর্তে!গর্তে ঢুকে যাব-যাব করতেই আকাশে চাঁদের
মায়াময় মুখ দেখে আমি নিজের ভিতর
পরিবর্তনের ছোঁয়া অনুভব করি। যেন আমি
কদাকর মূর্তির ভিতর থেকে সুন্দরের প্রিয় আবির্ভাব! (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | আবার এসেছো তুমি বৃক্ষতলে খর পুর্ণিমায়
নিঃশব্দে পেরিয়ে ডোরাকাটা পথ, শাড়ির হিল্লোল
তুলে নিরিবিলি, দেখলাম। মোহন ছন্দের দোল
তোমার সত্তায়, তুমি জোৎস্নাময় হেসে নিরালায়
চলো যাই বলে উঠে গেলে যানে, আস্তে পুনরায়
বসেছি তোমার পাশে আগেকার মতো, ডামাডোল
চতুর্দিকে, পুলিশের হুইসিল, কারো রাগী বোল
ভেসে আসে, কখনোবা রবীন্দ্রসংগীত বয়ে যায়।জ্যোৎস্নায় তোমার চোখ খৃষ্টপূর্ব শতকের হীরকের
মতো জ্বলে, আবার তোমার হাত মাছ হয়ে খেলা
করে একাকিনী আমার এ হাতে, আমরা পরস্পর
মুখোমুখি চেয়ে থাকি। কিন্তু আমাদের দুজনের
এই রাত্রি সত্য নয়। এতো কুহকের ভুল বেলা-
নিমেষেই অস্তমিত; তারপর কী শূন্য প্রহর! (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | ১
‘ঢের হয়েছে, আর নয়, ছাঁটো, ছাঁটো ক্ষয়া খর্বুটে শব্দাবলি। বাতিল করো
হরিণ, রাজহাঁস আর ঝাড়বাতি; তোমার কবিতায় এসব পড়ে পড়ে হাঁসফাঁস
লাগে। একই উপমা কেন ঘুরে ফিরে আসবে সকল ঋতুতে? এবার চেনা পথ
ছেড়ে ধরো অচেনা রাস্তা, বসিয়ে দাও চেকপোস্ট। জ্যোৎস্নাধোয়া ঝিলে
খিলখিলে হাওয়ায় মুখ ডোবায় হরিণ, কেন এই পুনরুক্তি? কেন তুমি বলবে
না জ্যোৎস্নার চাদর বিছানো প্রান্তরে ক্যাঙারুর পাল লাফিয়ে লাফিয়ে নষ্ট
করছে ফসল? কেনই বা তোমার কণ্ঠে উচ্চারিত হবে না যে, যা’ কিছু মহৎ,
সুন্দর, সহজ আর সরল তার দিকেই তিরিক্ষি মেজাজে তাকায় বন্দুকের নল।
কোনও তন্বী হাসলেই কেন দুলে উঠবে বারবার ঝাড়বাতি। উটের কুঁজোর
মতো বাড়তি চর্বি ঝেড়ে ফ্যালো। তীক্ষ্ণ, ছিপছিপে হোক পঙ্ক্তিমালা।
আগ্রাসী মরুভূমিতে তোমার কবিতা হোক এমন মরুদ্যান, যেখানে তুমিই
প্রথম মুসাফির’, বললো এক তরুণী কথায় কথায়। এভাবেই টেলিফোনে
সেদিন আমাকে সে কবিতা লেখার সহজ পাঠ শেখালো।২
অসম্ভব তাকে ভালোবাসা, অসম্ভব তাকে ভালো না বেসে জীবনলগ্ন থাকা।
এই রেশনবৎ কথাবার্তা, মাঝে-মাঝে বদখৎ ক্রস কানেকশন, টেলিফোনে
খণ্ডকালীন বসবাস, গৃহকোণে দুঃস্বপ্নের হামলে পড়া, সামলে সুমলে
চলাফেরা, সত্যমিথ্যার জটাজালে বন্দিদশা, কোত্থেকে আচমকা খসে আসা
কিছু পঙ্ক্তিকে ঘষা-মাজা টেবিলে, ভাঁড় সাজা কখনও সখনও, খোদাই ষাঁড়ের
গজরান, শক্রর ইতর খিস্তি খেউড়, গতরে জ্বালা-ধরানো, পেছনো, ঢেউয়ের
আনাগোনা-এসব নিয়েই আছি। প্রায়শঃই এরকম থাকি। যেন অপারেশান
টেবিলে শোয়ানো হয়েছে, অ্যানস্থেসিয়া একটু একটু করে ঢুকছে নাকে।
কাছাকাছি কেউ নেই; অকস্মাৎ কারো হাঁচিতে চটকা ভাঙে। বহুদূরে গহীন
গাঙে রঙিলা নায়েরমাঝি দাঁড় বায়, খাটায় পাল মসলিনের, কোথাও টিনের
ঘরের চালে চাঁদিমা বিছানো, দুধের পাতলা সর। মাঝে-মাঝে খুচরো কাজের
ঠেলাঠেলিতে বেলাবেলি তার কণ্ঠস্বর শুনে বাঁচি। পিটপিটে নক্ষত্র চোখ মারে;
আরে, শোনোই না, ভর সন্ধ্যেবেলা কোথায় যাচ্ছো? কোনও কথা কেউ শোনে
না, আলতো তাকায় ফিরে, বোনে যে যার স্বপ্নের শৌখিন শাড়ি অন্তহীন, কত
টানাপোড়েন। সসপ্যানে বাস্তবতার ঈষদুষ্ণ অমলেট, ঘরে ঘরে ছেলেমেয়ে
মানুষ করার হৈ-হুল্লোড়। পাড়ায় পাড়ায় চোর ছ্যাঁচোড়ের উৎপাত, ডাকাতের
দল নানা ছলছুতোয় উপর তলায় সমাসীন। কবিতার জন্মদ্বারে কালো
বেড়ালের ছোঁক ছোঁক। কবিপুরুষ ঢোঁক গিলে তড়িঘড়ি কবিতার ভ্রুণ সামলে
দ্যাখেন, নগ্ন পায়ে ফিরে যাচ্ছে ভালোবাসা।৩
দীপ জ্বালাতে গিয়ে আঙুল ঝলসে যায়। দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠি নতুন
কুলোয়, ছিপছিপে শরীর অর্ধেক ময়ূর হাতে এগোয় স্বপ্নের সীমানায়, রূপ
আমাকে গিলে খাবে। যাব কোন্ চুলোয়? হাসি, কাচের বাসন চূর্ণ মোজেইক
করা মেঝেতে। চুপচাপ থাকি, কাছের শেলফ থেকে বই টানি; পড়তে পড়তে
রাত বাড়ে। কে অমন আড়ালে দাঁড়িয়ে ঘুম কাড়ে? অতীতের ঘানি টেনে ক্লান্ত,
আপাততঃ থাক ধারাদেনার ভাবনা। রাগ সাপের মতো ফোঁসে, মাথার ভেতর
লকলকে আগুন। বেনামি আক্রোশে কুকুর মাটি খুঁড়তে থাকে গুম করা লাশ
বের করবে বলে। দুপুর রাতে শূন্য হাতে উড়ে এসে বসে ডুমুর; তার সরুঙ্গে
নোখে মেরুন পালিশ ছিল কি বিকেলে? ওর কাছে গেলে ভ্রূকুটি-অলা মেঘ
কেটে যাবে, রঙ-বেরুঙের পাখি কুড়াবে রুটি-বিস্কুটের টুকরো বারান্দায়,
ঝরাবে সুর চেতনায় নিমগ্ন স্তরে। কোন্ পথ ধরে যাব নিবাসে তার? পথগুলি
শয়তানের নাড়িভুঁড়ি; অলিতে গলিতে ঘুরি, উড়ি ময়ূর-নীল মেঘে। সে আছে
অজ্ঞাতবাসে। যা-কোনও রাস্তা ভাবি। স্বর্ণতালার দাবি, ‘খোলো,
দ্বার খোলো। কোথায় কবে হারিয়ে ফেলেছি চাবি। কী করে বইব বিচ্ছেদের
ভার? পূর্ব-পুরুষদের কেউ বিরহকাতর প্রহরে আমার মতোই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে
কেঁদেছেন রহস্যের গুহায়? নাকি বনবাদাড়ে পিছল আঁধারে কুপিয়ে কেটেছেন
হিজল গাছ ভুলতে অন্তর্জালা? বন্যবরাহ তেড়ে আসে যখন তখন অকারণ।
হেঁড়ে গলায় দশকওয়ারী ফিচেল ফতোয়া ঝাড়ে নানাবয়েসী মস্তান। কেন
টেলিফোন বেজে ওঠে না এখনও? যখন অতিশয় ব্যাকুল হয়ে সে ঘোরাবে
ডিজিট, তখন থাকব তো?৪
সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা খোঁয়াড়, লম্বাচওড়া, তারকাঁটার বেড়া দিয়ে
ঘেরা। শুয়োর, শুয়োর,শুয়োর। মদ্দা শুয়োর, মাদি শুয়োর। ডানে শুয়োর,
বামে শুয়োর। প্রচণ্ড গাদাগাদি, গুঁতোগুঁতি। উত্তরে শুয়োর, দক্ষিণে শুয়োর,
পূর্বে শুয়োর, পশ্চিমে শুয়োর। চারদিকে ছুটোছুটি, কাদায় লুটোপুটি। ঘোঁৎ,
ঘোঁৎ, ঘোঁৎ, কী শীত কী গ্রীষ্মে শুয়োরের গীত। কত মাদি শুয়োরের মাথায়
ঘোমটা, গলায় লাল কিংবা নীল রিবন শুয়োরেরা ফার্সি পড়ে হদ্দ হয়, আরশি
নগরে ক্লান্ত হয় সব্জির আঁটির মতো গুচ্ছের পদ্য পড়ে। কোনও কোনও শুয়োর
শোলার টোপর পরে ঘুরে বেড়ায় চরকি হয়ে। শুয়োর, শুয়োর, শুয়োর।
দিনরাত্রি নামে শুয়োরের ঢল। ফূর্তিমাতাল দাঁতাল শুয়োরের কেতাদুরস্ত
বুর্জোয়া চালে মাথা নাড়ে, মাদি শুয়োরের নজর কাড়ে, নিয়ে যায় নাচের
ফ্লোরে, যখন সূর্য অস্তাচলে। মোহকবলিত শুয়োর, যন্ত্রচালিত শুয়োর, শবলিত
শুয়োর। শুয়োরকে শূকর নামে ডাকলে অনেক শুয়োর যারপরনাই আহ্লাদিত
হয়। অতএব শূকর-শূকরী, শূকর-শূকরী, শূকর-শূকরী। শূকর-শূকরীর
রোদালো, ঝাঁঝালো, জ্যোৎস্না চমকিত জীবন বাঁশের বল্লম আর অজানা
জোয়ারের অপেক্ষায়। ভরাট খোঁয়াড়। শূকর, শূকর, শূকর। শূকরের
কামড়াকামড়ি, লালসা, শাঠ্যে আমরি নাট্যে রুমালে ঘন ঘন মুখের চামড়া
মোছে সূত্রধর।৫
স্বপ্নের ভর্তুকি নিয়ে কতকাল চলবে আর? একটি স্বপ্নাদ্য কবিতার
বিতিকিচ্ছি রূপ দেখে এজন কবি নিজেকেই প্রশ্ন করেন। একজন তোবড়ানো-
গাল কেরানি বাসে ঝুলতে ঝুলতে ভাবেন, আহা, সারা জীবন যদি গল্ফ খেলে
কাটিয়ে দেয়া যেত। গলা ফাটিয়ে এ-কথা দশ দিকে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে
তার। ভদ্রলোক যদি দয়া করে দশ পয়সার বদলে, খোদার ফজলে, একটি দশ
টাকার কড়কড়ে নোট দিতেন, একজন নুলো ভিখিরির ভাবনা। একজন
রিক্শা-অলা প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে মনে মনে আওড়ায়, হায়, এমন কি
হয় না যে, প্রতিটি রাস্তা খুব ছোট, অথচ ভাড়া দিব্যি চড়া। কবির মৃত্যু হলো
অনিয়মের অঙ্কুশাঘাতে, কেরানি অকূলে ভাসিয়ে সংসার গেল অন্তরীক্ষে
অচিকিৎস্য রোগের হাড়িকাঠে মাথা রেখে, রিকশা চালক ওর চঞ্চল পা দুটো
হারিয়ে হয়ে গেল আরও বেশি সর্বহারা, আর নুলো ভিখির আজও খুঁড়িয়ে
খুঁড়িয়ে দশ টাকার কড়কড়ে নোটের আশায় ভিক্ষা করে বেড়ায় সাত ঘাটে।৬
বেখাপ্পা লোকটা বারবার দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালায় আর নেভায়, বিড়ি
সিগারেট ধরায় না। সাধ ছিল তার ঐন্দ্রজালিক গালিচায় বসে পা দোলাতে
দোলাতে বিশ্ব ভ্রমণে উঠবে মেতে। দু’চারটি শালিক চড়ুই, কাকাতুয়া মুনিয়া
সঙ্গী হবে ওর আর থাকবে একজন, তামাম দুনিয়ায় যার নেই জুড়ি। প্রসন্ন
ছায়াবীথিতে সেই বিবাহিতা তরুণীর সিঁথিতে হঠাৎ পরিয়ে দেবে সিঁদুর, ইচ্ছে
নাচতো পুষ্ট লোকটার অন্তরে। ফুসমন্তরে ভোলায়নি, হৃৎমন্ত্র শুনিয়ে
সকালসন্ধ্যা প্রণয়ের বন্ধ্যাকালে দিয়েছে ডাক। জানাজানি হলে পাড়ায় ঢিঢি
পড়ে যাবে’ দুজনকেই গিলে খাবে সামাজিক রাক্ষুসে বোয়াল। সংস্কারের
কাঁকড়ার ভয়ে সিঁটিয়ে তরুণী কামনার মায়াবৃক্ষে চড়েনি, সিঁথিতে পরেনি
গোধূলিবেলায় বিয়ে-বিয়ে খেলার সিঁদুর। লোকটার কিছু হলে বিধবার
অপবাদ কী করে সইবে? দুর্বিষহ বিষাদকে পোষ্য নিয়ে পথ চেয়ে থাকে সেই
বিবাহিত-অবিবাহিতা তরুণী, চিরুনি কোলে আলস্য পোহায় এবং সারা শহর
জুড়ে খাপছাড়া লোকটার শুধু টো টো। কোনও বিলাপ নেই, নেই প্রলাপ;
উজাড় বাগানে ফুল ফোটানোর ব্রত ওর, অথচ ওকে কেবলি ঘিরে ধরে কিছু
ভীমরুল। ডাকাবুকো, বিটকেল লোকজন পিছু নেয়, লাগায় চড় চাপড়, দ্যায়
রুক্ষ মাটিতে ঘষটে তার স্বপ্নের মুখ।৭
বাতি নিভিয়ে শুয়ে যায় সে; কী তাজ্জব, রাতারাতি দু’হাতে গজায় ভৌতিক
ফণিমনসা। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে বিছানায়, নিজের ঘর ক্যাপ্টেন আহারের
কেবিন, মৃত্যুর পদহীন পদচারণায় অতিশয় নিস্তব্ধ। দেয়ালে মরা কুকুরের
নাড়িভূঁড়ি লেপ্টে আছে, একাকীত্বের একাঘ্নি ওর দিকে ধাবমান। হাত নিয়ে
নাজেহাল। মাথার একরাশ চুল শিশু নাগ, ওষুধের বাক্স তোলপাড় করে খায়
ঘুমের বড়ি। বারবার পাশ ফিরে শোয়, দুচোখে তপ্ত শলাকা ঢোকায় কে?
ঘুণপোকায় ধরেছে সত্তা; মূত্রাশয়ে বেরহম জ্বালা, বৃক্ক আক্রান্ত হলো বুঝি।
গলায় নরমুণ্ডের মালা পরে আসে কেউ বসে তার পাশে। ব্লাটিং পেপারে গড়া
মুখ চোখে রক্ত কিডনী ফেলে দিতে হবে মূর্গির বাতিল মাংসের মতো? ফের
কাটাছেঁড়া? বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস। ভোরেও রাত্রির জের, চেতনায় অমানিশার
ঘোর, ভবিষ্য ধুধু মরীচিকা। চোদিক থেকে আগুনের শিখা ধেয়ে আসে,
ছায়াচ্ছন্ন দিশা, তলপেটে হাজার হাজার সুঁচের হামলা, বৃশ্চিকের কামড়; প্রাণ
সামলানো দায়। মাটির তলায় পোকা মাকড়ের অধীর অপেক্ষা। বাঁচার বাসনা
অত্যধিক তৃষ্ণাকাতর মরুচারীর পাথরঘেঁরা পান্থপাদপ। খুনের নেশায়
তলোয়ার মাছ তার সমস্ত শরীর ছিঁড়ে ফেড়ে এঁকে বেঁকে চলে অতলে আর
আহত কত প্রার্থনা করে জীবনের রস। অসুখ এবং ওষুধের কলহান্তে আরেক
সকালে সে বসন্ত বাহার। (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | রাজনীতি আজকাল ধূর্ত, খল, ভ্রষ্ট, নীতিহীন
অতিশয়; রাজনীতি বড়োই কর্কশ, মিথ্যা বুলি
প্রায়শই সহিংসতা, মানুষের চোখে কড়া ঠুলি
পরিয়ে ঘোরানো, উপহার দেয়া ছলনার দিন।
রাজনীতি এমনকি সুন্দরীর মুখকেও খুব
কঠিন বিকৃত করে তোলে নিমেষে এবং চোখে
মুখে তার জ্বেলে দেয় চৈত্রদাহ, তখন ত্রিলোকে
প্রেমিক অনুপস্থিত, জলাশয়ে প্রেমও দেয় ডুব!তবুও বিবর্ণ জীবনের কাঠামোয় রাজনীতি
চাই আজ আমরা সবাই সুস্থতা ও প্রগতির
স্থির লক্ষ্যে, যেখানে ছলনা নেই, নেই কোনো ভীতি
ভ্রষ্টাচার, অকল্যাণ, আস্ফালন মারণাস্ত্র আর
সযত্নে লালিত সন্ত্রাসীর, যেখানে প্রেমিক নীড়
পেয়ে যায় অকর্কশ সুস্মিতা সত্তায় দয়িতার। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | পুবের আকাশে প্রতিদিন একই
সূর্য সকালে আবির মাখে।
কীর্তিনাশার প্রমত্তা রূপ
আজও খেলে যায় চরের বাঁকে।আমি শুধু আমি বদলে যাচ্ছি,
মানে মোট কথা হচ্ছি বুড়ো।
গতকল্যের কিছু নেই বাকি,
বিগত যুগের স্বপ্ন গুঁড়ো।দেয়ালের এই পিকাসো মাতিস
চির অক্ষয় থাকবে বটে;
অথচ আমার দেহের চিত্রে
কত কী-যে শুধু নিত্য ঘটে।চোখ ফেরালেই বছর ফুরায়,
কমে ক্রমাগত দেহের তাপ।
চোখের তলায় ত্বকে অঙ্কিত
কাকের পায়ের শীর্ণ ছাপ। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | মোরগের গর্বিত ঝুঁটি, স্বপ্নে-দেখা
রক্তিম ফুলের উন্মীলন, অন্ধকার ঠেলে
ঘোষণা করে, আজ তোমার জন্মদিন।
আমার হৃদয়ের রোদের ঝলক
পবিত্র, ভাস্বর আয়াতের ছন্দে জানায়,
আজ তোমার জন্মদিন।জানলার পাশে দাঁড়ানো
গাছের ডালে বসে-থাকা পাখির শিস
স্তব্ধতাকে চমকিয়ে শোনালো,
আজ তোমার জন্মদিন।
ঘরে হঠাৎ ঢুকে-পড়া ভ্রমর গুন্গুনিয়ে
বলে গেল আজ তার জন্মদিন,
যার চোখে চোখ রাখলে মনে হয়-
পৃথিবীতে নেমে এসেছে স্বর্গসিঁড়ি।আজ নার্সের অ্যাপ্রনের মতো সারসের শরীর
আরো বেশি শাদা আজ উজ্জ্বল,
সূর্যের আবীর আরো বেশি রঙিন হয়ে
প্রতিবিম্বিত দিনের গালে, নদী আরো বেশি নদী;
আজ ফুলের স্তবকগুলো আনন্দের, রবীন্দ্রনাথের গান
অধিক রাবিন্দ্রিক এবং
আকাশের অধিক দূরের আকাশ।
আয়ুষ্মতী শব্দটি প্রকৃতির কণ্ঠে
উদারা মুদারায় বাজতে থাকে অষ্টপ্রহর।
তোমার জন্মদিন দেখছে, আমি সেই কবে থেকে
টেবিলে ঝুঁকে উদ্যমকে ফোঁটা ফোঁটা মুক্তোয়
রূপান্তরিত করে একটি কবিতা লিখছি,
যার পর্বে পর্বে তোমার সুগন্ধি নিঃশ্বাস,
স্তনের ওঠা-নামা আর চুলের ছায়া।
আমার অসমাপ্ত কবিতাকে
দুরন্ত হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে
দূরের ফ্ল্যাটে গিয়ে চুপিসারে
গুঁজে দিতে চায় তোমার ব্লাউজের ভেতর।
তোমার জন্মদিন আমার চুলে
আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছে সকালবেলা,
পায়ের কাছে জাগিয়ে তুলছে একটি ঝর্ণা।আজ তোমার জন্মদিন। কী উপহার
কিনবো তোমার জন্যে? শাড়ি-টাড়ি? না কি
ফুলের তোড়া? অথচ এই সবকিছুই বড় মামুলি।কী সেই উপহার, যার তুলনায় হীরের নেকলেসও
অতিশয় তুচ্ছ? হৃদয়,
যা আমি আগেই অর্পণ করেছি তোমাকে
কোনো এক দুপুরে অতীত বর্তমান মুছে-দেয়া বিহ্বলতায়।
তবু আর কিছু নয়, কেবল এই ধুক পুক করা
বুক নিয়ে দাঁড়াতে চাই
তোমার সামনে। আমাদের সম্পর্কের ওপর
ফুল ঝরুক, ঝরুক স্বর্গশিশির।
তোমার জন্মদিন সবার অগোচরে কী উন্মুখ
চুমো খাচ্ছে আমাকে তোমার মতোই। (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | এই তো বৃষ্টি ছাঁট আর ঝোড়ো হাওয়া
ময়লা আকাশটাকে ঝাঁট
দিয়ে গেল। বসে আছি ঘরে
বড় একা; নিজের ভেতরে এক আরশিনগরে কারো ছায়া
পড়ে বলে মনে হয়। পড়শির সঙ্গে দেখা।
যথারীতি জমে যাবে মাদারির খেল। ন্যায়নীতি
নিয়ে কানামাছি খেলি, ভয়ভীতি বিসর্জন দিতে
পেরেছি কি? বিবেকের আঁশ
এখনো আছে কি কিছু লেগে অস্তিত্বের তন্তুজালে?
কালে কালে কী যে হবে। অলীক বৈভবে
সতৃষ্ণ নজর রেখে মরমিয়া চাদরে গা ঢেকে ঘুর ঘুর
করে যায় যারা যুগে যুগে
ছুঁৎমার্গে ভুগে ঘোর রাজনীতিবিদ্বেষী এবং
কাচ ঘেরা গা বাঁচিয়ে তাদের হিসেব নেবে যারা
একদিন, তারা জানি বাড়ছে গোকূলে সুনিশ্চিত
সেদিন বুঝবে ওরা কত ধানে কত হয় চাল।একদা বিপ্লবী নেতা, আজকাল টাউকো টাউট, সাড়ম্বরে
ব্যাঙ্গের মতন গলা ফুলিয়ে দরাজ
কণ্ঠস্বরে খাল কেটে কুমির আনার বেমিসাল
মন্ত্রণা ঢালেন
প্রভুর লোহার তৈরি কানে, সে মন্ত্রণা
কী পুলক আনে তাঁকে ঘিরে-থাকা মৌমাছির মতো
চেলা-চামুণ্ডার মনে আর
সূক্ষ্ম কলা কৈবল্যবাদের গোধূলির
উদ্যান সভায়
চাটুকার স্ফীতোদর পদ্যকার ভণে,
‘অমৃত সমান
আমার সকল
আমার সকল শ্লোক গজদন্ত মিনারে রচিত
প্রভুর কৃপায়, জয় হোক, জয় হোক মহাত্মার।
চতুর্দিকে সামাল সামাল ভাই রব,
বানে ভাসে দেশ, রিলিফের মাল আসে ঝকঝকে
বিদেশী জাহাজে, কারো বলিহারি পৌষমাস আর
কারো সর্বনাশ,
বন্যার পানিতে খেলা করে মৃত্যু, সূর্যাস্তের সোনা।
মুশকিল আসান হবে কবে?
দুঃখীদের দুর্দশায়
বিজ্ঞাপনী কুম্ভীরাশ্রু দেখি
কী রঙিন। মন্দিরে বাজছে ঘণ্টা, গির্জায় অর্গান,
মসজিদে ধ্রুপদী আজান।৩
দেশ কি উইয়ের ঢিবি? নইলে
কেন এই মোচ্ছব চৌদিকে বল্মীকের? নৈঃসঙ্গের
মৌতাতে বিভোর বুদ্ধজীবী
কফিন পেয়ালা হাতে স্তব্ধ হয়ে আছেন এবং
উদভ্রান্ত বেকার যুবকের দম মারে ঘন ঘন
গাঁজার ছিলেমে, রাজবন্দিরা যখন
দিন গুনছেন
জেলের চোয়াল থেকে তাঁরা
জনতার হ্যাঁচকা টানে
কখন পাবেন ছাড়া জনতার হ্যাঁচকা টানে আর
লঙ্কাকাণ্ড বাধবে কখন,
তখন অনেকে খোশহাল দস্তখত
মগজে দেয়ালি জ্বেলে দিন দুপুরেই। কী দরকার সর্বক্ষণ
খাঁড়ার ছোয়ায় বেঁচে? নিজে
বাঁচাল বাপের নাম। ঝুঁকিটুকি নিয়ে
লাভ নেই, তার চেয়ে এসো
অন্তত জলসাঘরে বিশুদ্ধ কবিতা নিয়ে মেতে সন্ধ্যেবেলা
নিয়ত নরক গুলজার করি, মডকেও, বন্ধু, হেসে মরি। |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | পঁচিশ বছর ধরে তোমাকে রেখেছি ভরে এই
হৃদয়ে আমার, যেন শকুনের চঞ্চু ও নখর
ব্যর্থ হয় তোমার দুচোখ তুলে নিতে, যেন কোনো
জখম না হয় অঙ্গে। থাকো তুমি সর্বদা নিখুঁত
পদ্মের ধরনে, এই স্বপ্ন আমাকে বসিয়ে রাখে নিত্য
প্রান্তরে, দিঘির ঘাটে, বকুলতলায়। কবিতাকে
বারবার করেছি উৎসর্গ ভালোবেসে অরুণিমা
তনিমার, যা তোমার। হৃদয়ের রৌদ্র-জ্যোৎস্না নাও।তোমাকে বিকৃত করে, অপবাদে কালিমায় মুখ
লেপে দিয়ে বেজায় অনগ্রসর উদ্ভট মানুষ
কতিপয় বাজায় কর্কশ ঢোল, অন্ধকার স্রোত
কেবলি বইয়ে দেয় মগজের কোষে দিনরাত।
কোকিল, দোয়েল গানে গানে বাগানের পথে আনে
বসন্ত, পূর্ণিমা, তুমি, স্বাধীনতা, স্বাগত জানাও। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | দীর্ঘ খরা দেখে দেখে দু’চোখ ভীষণ ঝলসানো;
অকস্মাৎ ফসলের ঢেউ খেলে যায়, আবাদের
ঘ্রাণে প্রাণ মাতোয়ারা এবং একটি বাগানের
উদ্ভাসনে মনে হয় পটভূমি কেমন পাল্টানো।
বাগানের ফুল, পাখি, মৃদু হাওয়া ডেকে বলে, ‘আনো
জীবনে নতুন করে বাঁচার ফোয়ার; তুমি ঢের
ঘুরেছ বিপথে, বুঝি কখনো-বা আজো তার জের
ছায়া হয়ে নাচে, বিভ্রম ও সব দুঃস্বপ্নকে হানো।বাগানের শোভা মনে জাগায় উৎসব, লহমায়
মুছে ফেলে নিস্তেজ শরীর থেকে ধুলো আর স্বেদ
দয়িতার স্পর্শ হয়ে। অথচ সে বাগানের মাটি
ফুঁড়ে অমাবস্যা রাতে খটখটে কঙ্কাল হাওয়ায়
ভাসে, হাসে; বিষধর সাপ গাছের বাকল ভেদ
করে তেড়ে আসে, সঙ্গী হয় প্রেত, তারই পাশে হাঁটি। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | আমার সত্তায় উদ্ভাসিত রৌদ্রী একটি সকাল,
অস্তিত্বের তটরেখা গুঞ্জরিত সানাইয়ের সুর
ক্ষণে ক্ষণে; দাঁত মাজি, চেয়ে দেখি এইতো অদূরে
উঠোনে কুড়োয় খুশি হল্দে পাখি, অসুখী বেড়াল
আমার লেপের নিচে খোঁজে উষ্ণ গুহা; নিম ডাল
নেচে ওঠে অকস্মাৎ। বহুদূর দেশ থেকে এসে
কখনো ফিরে না-যাওয়া বৃদ্ধলোক লাঠি হাতে, হেসে
কুশল শুধান পড়শির-গলিময় ইন্দ্রজাল।আমার পায়ের নিচে পড়ে আছে খবর কাগজ
নীরব বিশ্বের মতো। কফি খাই, আশ্চর্যের ধূপে
সমাচ্ছন্ন কবিতার খাতা খুলি, বাস্তবের সীমা
ছিঁড়ে ফেলি ফালা ফালা, ছকস্থিত অশ্ব আর গজ
সুনীল প্রান্তরে ছোটে আশ্চর্যের তরঙ্গের রূপে-
সব চে আশ্চর্য তুমি হে আমার আপন প্রতিমা। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | একদা, তোমাকে আমি অহংকারী বলে জানতাম। মনে পড়ে,
কোনো এক পঁচিশে বৈশাখে
তুমি আর আমি পাশাপাশি ছিলাম কী মুগ্ধ বসে।
চিনতে পারনি তুমি পাশে-বসে-থাকা জবুথবু
তরুণকে যার
কবিতা তখন এ শহরে যত্রতত্র
বাচ্চা রাজহাঁসের মতন
পাখা ঝাপটাত, সেই পদাবলি পাঠক গোষ্ঠীকে দিয়েছিল
ভীষণ ভড়কে আর উদাসীন পণ্ডিতবর্গের
টেরিকাটা দামি মাথা চুলকোতে বাধ্য করেছিল।
তুমি একবারও তার দিকে, এমনকি তাচ্ছিল্যভরেও, ফিরে
তাকাওনি; দৃষ্টি ছিল মঞ্চে, কখনোবা কিছু দর্শকের প্রতি।
প্রকৃত রানীর মতো ছিলে তুমি সে আসরে
অমন সুদুর একাকিনী। কী মদির তাপ গোলাপি নেশার মতো
তোমার নিজস্ব পারফিউমের মতো
আমার সত্তায় হল সঞ্চারিত; সকালের আকাশের মতো
কী সহজ আভিজাত্য ছিল তোমার অস্তিত্বে ব্যাপ্ত
এবং আমার ঠোঁট দুটি অদৃশ্য পাখির মতো
গান গাইছিল স্মিত তোমার শরীরে সারাক্ষণ।
সে রাতে তরুণ কবি অর্জিত মোহন কাম তার
অন্য কারো নিবেদিত শরীরে উৎসর্গ করেছিল,
অথচ তুমিই ছিলে, শুধু তুমি তার
অস্তিত্বে অণুপরমাণুময়।
তোমাকে দেখেছি আমি দূর থেকে ঊনসত্তরের
পদধ্বনিময় দিনে, করেছি আবৃত্তি
তোমার উজ্জ্বল মুখ, চকচকে চোখ, কালো চুলের গৌরব,
মধ্যরাতে বৈমাত্রের পরিবেশে কবিতা লেখার ফাঁকে ফাঁকে।
একাত্তরে গুলিবিদ্ধ ঈগলের মতো রক্তাপ্লুত
বিধ্বস্ত শহরে থেকে সবুজ গ্রামের অভ্যন্তরে
পলাতক হয়েছি যখন,
তখনও তোমার কথা হৃদয়কে বলেছি নিভৃতে
দীর্ঘশ্বাসসহ-যে উতল দীর্ঘশ্বাসে মিশ্র স্মৃতি,পঁচিশে বৈশাখ, চৈত্রপাতা, বৃষ্টিপাত, ধু-ধু মাঠ,
প্রেতায়িত ঘোড়াদের লাফ,
ধ্বংসস্তূপ সেতারের ব্যাকুল বেহাগ, দেয়ালের
কী বিমূর্ত দাগ, ছত্রভংগ মিছিলের প্রজ্বলিত আর্তনাদ-
মাছরাঙা পাখি, মাছ, শাপলা শালুক দেখার সময়।
এখন কেমন আছ তুমি? এখন তো
আঁধার চিৎকার করে অগ্নিদগ্ধ ঘোড়ার মতন।
যখন আলিজিরিয়া যুদ্ধক্ষুব্ধ ছিল, জামিলাকে
নেকড়ের পাল ছিঁড়ে-খুঁড়ে মেতেছিল খুব পৈশাচী উল্লাসে,
ফিলিস্তিনি লায়লাকে ঝাঁক ঝাঁক ডালকুত্তা তুমুল তাড়িয়ে
বেড়িয়েছে রাত্রিদিন, তখন কোথায় ছিলে তুমি?
তখন কেমন ছিলে তুমি?
যখন চেগুয়েভারা ছিলেন কাদায় পড়ে বলিভিয়ার জঙ্গলে তাঁর
নিঃসাড় তর্জনী রেখে মুক্তি ও সাম্যের দিকে, দীপ্র
সূর্যোদয়ের উদ্দেশে
তখন কোথায় ছিলে তুমি?
তখন কেমন ছিলে তুমি?ও দৃষ্টির সরিয়ে নাও আমার অস্তিত্ব থেকে, আমি
পুড়ে যাচ্ছি, হে মহিলা, মদির অনলে।
এ দাহ অসহ্য তবু তোমার কাছেই যেতে চাই বারংবার,
তোমার নিঝুম ঘাটে তুলে নিতে চাই
আঁজলা আঁজলা জল অকূল তৃষ্ণায়।
কখনো ভাবিনি আগে এতকাল পরে দেখা হবে পুনরায়,
কখনো ভাবিনি আগে কোনো দিন বসব তোমার
মুখোমুখি, আমাদের সংলাপে মুখর হবে অনেক প্রহর,
কাফকা ডস্টয়ভস্কি এসে বসবেন অপরাহ্নে চায়ের সময়,
চায়ের পেয়ালা তুমি সুন্দর ভঙ্গিতে তুলে দেবে
আমার ব্যাকুল হাতে, অন্ধকার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
আমাকে ফেরত দেবে ভুলে ফেলে-আসা।
পকেট চিরুনি।
তোমার গ্রীবার ডালে প্রত্যহ রজনীগন্ধা ফোটে,
দেখি আমি দেখি।
চারদিকে নিদ্রামগ্ন ফেরেশতার মতো জ্যোৎস্না, তুমি
জ্যোৎস্নার অধিক স্নিগ্ধতায় স্বপ্ন হয়ে আছ, দেখি
আমি দেখি।জ্যোৎস্নার নেকাব ছিঁড়ে মাঝে-মাঝে কাক উড়ে যায়।
কত কথা বলো তুমি, অথচ যে-কথা
শোনার আশায় আমি থাকি প্রতীক্ষায় প্রতিদিন,
কাটাই নির্ঘুম রাত্রি, সে-কথা সর্বদা ভার্জিনিয়া উলফের
দূর বাতিঘরের আড়ালে, স্যামুয়েল
বেকেটের নরকের অন্তরালে চাপা পড়ে যায়।
কয়েদির খুপরির ঘুলঘুলি পেরুনো আলোর মতো
কার্পণ্য তোমার,
এবং আমিও যে গোপন উচ্চারণ চাই আমার আপনকার ঠোঁটে
তা-ও নিমেষেই
প্রস্তর যুগের স্তব্ধতার মতো অনুচ্চার থেকে যায়, জানি
অন্তর্গত বাসনার বসন্ত আমার
পুষ্পিত হবে না কোনো দিন।
জ্যোৎস্নার নেকাব ছিঁড়ে মাঝে মাঝে কাক উড়ে যায়। (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | পৃথিবী এখনো খুব সজীব সুন্দর ভোরবেলা
নতুন মাছের মতো কেলিপরায়ণ, নীলাকাশে
সারস প্রফুল্ল ওড়ে, ঝিলে নামে নিভৃত আশ্বাসে
তৃষ্ণার্ত কোমল প্রাণী বনপ্রান্তে পথিক একেলা
হেঁটে যায়, গেরস্থের উঠোনে শিশুর রাঙা খেলা
জমে অপরাহ্নে রোজ। নিশুত নিশীথে স্বপ্ন আসে
পরাবাস্তবের হরিণের মতো স্মৃতির আভাসে,
ছাদের কার্নিশে একা পাখি ডাকে গভীর সুরেলা।পৃথিবী আনন্দময় বস্তুত এখনো। সুর কাটে
মাঝে মধ্যে, তবু এক দীপ্তিমান উল্লসিত সুর
বয়ে যায় সবখানে। শুধু আমি মানুষের হাটে
একাকী বিষণ্ণ ঘুরি এবং যখন যেখানেই
যাই, সত্তা জুড়ে বাজে সর্বক্ষণ আর্ত অশ্বক্ষুর,
কেননা আমার বিশ্বে আজ আর সে নেই, সে নেই। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | জানো কি কোথায় আছি? আমার নিবাস
একটি ঠিকানা শুধু, বলা যায়, ফেলে-যাওয়া কোনো
খামে লেখা, তোমার নিকট,
তার বেশি নয়।এ-ঘরে আসোনি কোনোদিন,
কী রকম ভাবে
কাটে বেলা এখানে আমার, পায়চারি
করি কতক্ষণ কিংবা চেয়ারে হেলান
দিয়ে দূর আকাশের দিকে
তাকাই কখন, কতটুকু
দেখি প্রজাপতিদের ওড়াউড়ি, অথবা কখন
কী মোহন ভূতগ্রস্ততায়
লেখার টেবিলে ঝুঁকে গোলাপ এবং
ফণিমনসার ঘ্রাণময়
পর্ব ভাগ করি,
তোমার অজানা।আজো আছি, অসুস্থ বৃদ্ধের
ঈষৎ কাঁপুনি
বাড়িটার সার গায়ে। মেশিনের ঝাঁকুনি সত্তায়
গাঁথা, টলে মাথা, বুক কখনো মেঘলা
হয়ে আসে। মাঝে-মাঝে বড় অবাস্তব
মনে হয় এই ডেরা। তোমার নমিত
পদচ্ছাপ এখানে পড়েনি বলে? চোখ
ফটোগ্রাফে, অন্য ছবি, এলোমেলো, ছায়া ফেলে মনে হয়;
কিছুই হবে না জানি, অথচ সর্বদা অপেক্ষার
চোখ অনর্গল।শিরাপুঞ্জে মেশা
আজো বটে অসংখ্য জোনাকি।
বাসা-বদলের নেশা নেই, তবু যেতে চাই, দেখি
ছায়াচ্ছন্ন চিত্রনাট্যে নানা দেশী উদ্বাস্তর ভিড়,
গুপ্ত প্রেসে ছাপা
পুস্তিকার মতো ভবিষ্যৎ
জপায় নিষিদ্ধ মন্ত্র। যদি
তুমি কোনোদিন আসো এখানে এ-ঘরে
দেখবে তখনও আছি, নাকি পর্যটনে
দৃশ্যান্তরে? হবে না তেমন
প্রত্যহ কিশোর খোজে যেন
কিছুই, হলেও নেই ক্ষতি।
অলক্ষ্যে প্রকৃত
আমার নিকট আমি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি প্রতিদিন। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | সকালে দাড়িতে খর রেজার চালানো, ডোরাকাটা
তুর্কী
টাওয়েলে প্রভাতী ভেজা মাথা মোছা, শুকনো রুটি
চিবোনো, অফিসে
কী ব্যস্ত রুটিন যাত্রা, টেলিফোন, টেলিগ্রাম, চিঠি,
জরুরি এবং অদরকারী, রাশি-রাশি, নীরস সংলাপ,
মাঝে মাঝে টিনবদ্ধ খাদ্যের মতন প্রেমকথা,
সান্ধ্য আড্ডা, ঘুম, কোনো-কোনো রাতে কর্কশ অনিদ্রা
একটানা, সকালে দাড়িতে খর রেজার চালানো।
অকস্মাৎ ঘুমে নাকি জাগরণে, যেন কুয়াশার
অন্তরাল থেকে দেখা সামুদ্রিক উদ্যানে অজস্র
ব্যালে নর্তকের মতো মাছ, প্রবালের গা ছুঁয়ে একটি
সবুজ কাছিম নেচে ওঠে।
বাজি ধরি, মাঝে-মধ্যে নিজের সঙ্গেই বাজি ধরি-
হেড আর টেল, হেড আর টেল, হেড হেড হেড,
টেল টেল টেল
হেড টেল হেড
টেল হেড টেল।
আমার তিনটি শার্ট পড়ন্ত বিকেলে খুব উৎফুল্ল সারস,
হেড।
আমার চোখের অভ্যন্তরে নক্ষত্রের অভিসার বারংবার,
টেল।
দর্জির দোকানে ট্রাউজার ঈগলের ডানা হ’য়ে
মেঘলোকে উধাও সম্প্রতি-
হেড
গলির সেলুনে সাবানের বিবর্ণ বাটিতে ভাসে
সুগন্ধি নারীর ঘ্রাণ, টেল।
একটি সোনালি সিংহ গোলাপের সঙ্গে প্রেম করে,
হেড।
অন্ধকারে খনি শ্রমিকের ভারী পদধ্বনি সুখদ ব্যালাড,
টেল।
এই তো পায়ের নিচে বাদশাহী মোহর লুকনো,
হেড।
রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের সবগুলো ঝকঝকে নোট ওড়ে
পরীদের গাউনের মতো,
টেল।
কবির হাদয়ে পিয়ানোর বিড় সমুদয় নৃত্যপর,
হেড।
আইবুড়ো মেয়েটির আঙুলে ফোয়ারা, অলৌকিক,
টেল।
গ্রীষ্মের প্রখর আলপিন ফোটে সমস্ত শরীরে,
লালট ঈষৎ সিক্ত মাঠ, ক্লান্তি, চোখে তীব্র জ্বালা,
পুলিশের বাঁশি বাজে ঘোলাটে দুপুরে,
ত্র্যাম্বুলেন্স কী ক্ষিপ্র ছুটেছে হাওয়া চিরে
প্রশস্ত রাস্তায়, হাসপাতালের বেডে রোগী
আসে, রোগী যায়, হায়, লেগেছে আগুন-
দমকল বাহিনী কোথায়?
অকস্মাৎ ঘুমে নাকি জাগরণে, বুঝি কুয়াশার
অন্তরাল থেকে দেখা-পাতালের প্রবাল সিঁড়ির
স্মিত ধাপে গহন স্বপ্নের ম্যাক্সি-পরা তুমি, অবিকল তুমি,
শুধু তুমি। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | তোমার বয়স কত হলো ঠিক? ঝড়ে-জলে আজ
তেষট্রি পেরুলে বুঝি। আমিও তোমাকে সুপ্রাচীন
ধুমল কাগুজে স্তূপে অতিশয় পরিণামহীন
বিবর্ণ দলিল ভেবে বস্তুত ছিলাম ভুলে। বাজ
পাখি বলে রটেনি তোমার নাম কিংবা অধিরাজ
ছিলে না কখনো কোনো কবিসংঘে। বড় বেশি ক্ষীণ
স্বাস্থ্য আজ; হাঁপানি এবং বাতে কাটে নিশিদিন।
ছিল না তোমার পদ্যে বিশ্ববীক্ষা, সূক্ষ্ম কারুকাজ।বেঠিক মাটিতে তুমি ছড়িয়েছো বীজ ক্রমাগত
বছর বছর? কিন্তু জানি, কখনো সখনো ভুল
মাটিতেও ফলে কত আশ্চর্য ফসল অবিরত!
যদিও তোমার গোলা শূন্য, তবু রক্তপায়ী মাঠে
স্বেদক্ষরণের কথা ভেবে যেন তোমারই চৌকাঠে
করুন প্রত্যহ পুষ্পবৃষ্টি দয়ালু ফেরেশতাকুল। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | তোমার কি মনে পড়ে দিবপ্রহরে নিরিবিলি ঘরে
কতদিন কাটিয়েছি ভালোবেসে কিছুটা সময়
পরস্পর, কী আমরা বলেছি তখন, ঘরময়
কেমন সৌরভ ছিলো মৃদু তোমার কি মনে পড়ে?
তোমার দু’চোখে দৃষ্টি মেলে দিয়ে কী স্নিগ্ধ নির্ঝরে
মিটিয়ে প্রখর তৃষ্ণা পুনরায় পেয়েছি অভয়
দুঃসময়ে; ভুলে গেছি কে অর্জুজ কেই বা সঞ্জয়
সর্বগত্রাসী দাবানলে, দিকচিহ্নলোপকারী ঝড়ে।ঝড়ের পরেও দেখি আমরা দুজন মুখোমুখি
বসে আছি, জীবনের বন্দনায় স্পন্দিত এবং
নিজেরাই হয়ে গেছি গান, বিভ্রান্তির কালো রঙ
মুছে গেছে সত্তা থেকে, মনে হয়। এখন দাঁড়াবো
সুস্থির জমিনে তুমি আর আমি হবো দীপ্র সুখী।
ফের ভাবি-কেন বেঁচে আছি, কেনই বা মরে যাবো? (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | এই লেখা উঠে এসেছে তোমার স্বদেশের বুক থেকে,
এই খেলা উঠে এসেছে এ দেশের প্রতিটি নদী থেকে,
যে সব নদী তরঙ্গায়িত হতো তোমার শিরা উপশিরায়,
এই খেলা উঠে এসেছে সেসব ক্ষেত থেকে,
যাদের ফসলের ঢেউ ধারণ করতো তোমার হৃদয়।এই লেখা উঠে এসেছে তোমার প্রাণের স্বদেশের
গাছের শেকড়, পাখির বাসা, মাছের চোখ,
কৃষকের চঞ্চল লাঙল, শ্রমিকের শ্রমনিষ্ঠ হাত,
শত শত শহীদের জনক জননীর বিলাপ
বিচ্ছেদকাতর পক্ষিণীর মতো জীবন সঙ্গিনীর দীর্ঘশ্বাস,
আর
সন্তানের আর্তনাদ থেকে।এই লেখা উঠে এসেছে সেই সিঁড়ি থেকে,
যেখানে পড়েছিলো ঘাতকের গুলিবিদ্ধ তোমার লাশ,
এই লেখা উঠে এসেছে তোমার বুক জোড়া রক্তাক্ত
গোলাপ থেকে
বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া নব পরিণীতার
মেহদি-রাঙা হাত এবং
শিশুর নেকড়ে খোবলানো শরীর থেকে।তোমার দিকে ওরা ছুঁড়ে দিয়েছিলো মৃত্যু,
কিন্তু ওরা জানতো না,
কোনো কোনো মৃত্যু জীবনের চেয়েও সতেজ মহিমান্বিত,
তোমার মৃত্যুর কাছে কোটি কোটি জীবন আজো নতজানু,
তোমার গুলিবিদ্ধ শরীর এখনো
রাজপথ-উপচে-পড়া মিছিলের সামনে।
যেখানে সমাজ বদলে ফেলার প্রেরণাময় বাঙ্ময় হয়
কোনো তরুণ কণ্ঠ, সেখানে বেজে ওঠে তোমার কণ্ঠস্বর,
যেখানে বুলেটের আঘাতে ঢলে পড়ে কোনো সংগ্রামীর
শরীর,
যেখানে আবার লাফিয়ে পড়ে তোমার দীর্ঘ, ঋজু দেহ,
যেখানে প্রতিবাদে উত্তোলিত হয় বাহুর অরণ্য,
সেখানে সবচেয়ে উঁচু তোমার সূর্যঝলসিত হাত।
এমন কোনো হাই-রাইজ দালান নেই এই শহরে,
যা তোমার উচ্চতাকে খর্ব করতে পারে।
এইতো আমরা দেখছি রৌদ্রময় মাঠে মধ্যবয়সী
কৃষকের সঙ্গে তুমি লাঙল ঠেলছো কড়া-পড়া হাতে,
এইতো তুমি খালি পায়ে এবড়ো খেবড়ো জমিনে হেঁটে
হেঁটে
গুণ টানছো নদীতে, দাঁড় বাইছো মাঝির সঙ্গে,
কারখানার চাকা ঘোরাচ্ছো মজুরের সঙ্গে
কাদায় দেবে-যাওয়া চাকা ঠেলে তুলছো গাড়িয়াল
ভাইয়ের
হাতে হাত লাগিয়ে;
সুন্দর ও কল্যাণের স্বপ্ন দেখছো
ওডেসিউসের মতো বেরিয়ে পড়েছো নব অভিযানে।
আদর্শবাদী তরুণের স্বপ্নে মিশে গিয়ে। এইতো তুমি
কসাইখানাকে ফুলের বাগান বানানো যার সাধনা,
তুমি সেই সাধনার অকম্পিত শিখা।
তোমাকে ওরা অবজ্ঞায়, অপমানে, অবহেলায়
ঠেলে দিয়েছিলো এই বাংলার অজ পাড়াগাঁয়ে
এক কবরে, অথচ আজ চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে
তোমারই পদধ্বনি, আলো-জাগানো ভাস্বর পদধ্বনি। (হরিণের হাড় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | বকুলের ঘ্রাণময় পথে কিংবা শেফালির নিজস্ব ট্রাফিক আইল্যান্ডে
কার সাথে রফা করে প্রেমের এগারো দফা কর্মসূচি আমি
বাস্তবায়নের পন্থা বেছে নেবো? আমার এ প্রশ্নে সন্ধ্যেবেলা
বকুল বিমর্ষ ঝরে যায়,
শেফালির চোখেবাষ্প জমে। পথে পাতা, রাশি রাশি, ডালপালা, মৃত পাখি দেখে
এখানে একটা কিছু ঘটে গেছে ভয়ংকর, যে কোনো পথিক
বলে দিতে পারে সহজেই। একটি মানুষ তার একাকীত্ব
নিজের ভেতরে রেখে হেঁটে গেছে কতবার এ রকম
দৃশ্যের ভিতরে।
তার হাতে ছিল স্মিত অমল পতাকা, চোখে দূরত্বের আভা,
তার দীর্ঘ ভ্রমণের স্বীকৃতি রয়েছে কত নিরালা নিশ্বাসে,
ভরপুর সারাবেলা, কেমন অচেনা গানে গুঞ্জরিত
সরাইখানায়।
ভ্রমণ ছাড়া কি পথিকের অন্য কাজ নেই? পথে কত গহন দুপুর
কত অমানিশা তাকে ঢেকে দ্যায় কোমল আদরে?
সবুজ রৌদ্রের কাছে বেগুনি জ্যোৎস্নার কাছে হাত
পেতে সে কি
চেয়ে নেয় কিছু ঝুলি ভরে তোলার আগ্রহে?
এবার প্রশ্নের পর প্রশ্ন বারংবারচঞ্চু ঠোকে; যেতে যেতে দেখে যাই আমার নিজের আকাঙ্ক্ষাকে
আমি গলা টিপে হত্যা করি; সন্ধ্যেবেলা
গোলাপ-স্পন্দিত পথে নিঝুম গ্রহণ করে কত মৃতদেহ।
হত্যাকারী বড় একা, পরিত্যক্ত; চরাচর আর্তনাদ করে।
বহুদিন থেকে যোগফল নিয়ে ভাবছি, অথচ বারংবার
বিয়োগ করতে হয়, বিয়োগান্ত হয়ে যাচ্ছে অনেক কিছুই।
দেখেছি সতেজ সুখ কতদিন বাইসাইকেল
চালাতে চালাতে গায়ে খড়কুটো, শুকনো পাতা
ফুলের পরাগ,
কখনো বা টুকরো টুকরো রঙিন কাগজ
নিয়ে টগবগে গান গেয়ে হাসিমুখে গেছে দিগন্তের দিকে।
হঠাৎ কোত্থেকে দুঃখ চায়ের দোকানে এসে বসে
আমার টেবিলে হাত রেখে;
মুখোমুখি বসে থাকে বহুক্ষণ, বলেনা কিছুই।
কেবল চামচ নাড়ে, বিস্কুটের ভগ্নাংশ খিমচে তুলে নেয়
নখ দিয়ে নিরিবিলি ভীষণ ঔদাস্যে,
যেন কবি-মূর্তি, সামাজিক দাবি ভুলে, সর্বস্ব খুইয়ে
স্বপ্ন পেতে চায়।সন্ধ্যেবেলা খুব শূন্য হয়ে গেছে ইদানীং। পাখি ডাকে
পাতা ঝরে,
একজন গৌণ ব্যক্তি বসে থাকে খুনীর মতোন একা, তার
মুখ কবরের ঘাসে থুবড়ে পড়ে আছে কাদামাখা,
পোকা মাকড়ের মধ্যে। সুন্দরের পায়ে চুমু খেয়ে
ক্ষয়ে যায় ক্ষয়ে যায়, আপনার নিশ্বাসের প্রতি
বিরূপ সে ইদানীং, দীর্ঘশ্বাস হয়ে তাকে। নিজেকে কর্কশ
লাগে তার।ভালোবাসা যদি পুনরায় ফুল্ল মুখ তুলে চায়
ভালোবেসে, তবে আমি বাইসাইকেল চালিয়ে দিগন্তে যাবো
বকুল শেফালি আর জুঁই নীল দীর্ঘ পথে ছড়াতে ছড়াতে। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | আগুনে-পোড়া তরঙ্গের মতো আমার স্বপ্নগুলোকে
গোছানোর ব্যগ্রতায় অধিক
এলোমেলো করে ফেলি। আমার স্বপ্নগুলোকে
যারা পুড়িয়ে দিয়েছে, তাদের আস্তানায়
আজ মোচ্ছব। আমি আমার আর্তনাদকে
মেঘের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে
আগুন রঙের গুচ্ছ গুচ্ছ কৃষ্ণচূড়ার মধ্যে
মুখ লুকাই।এক সম্পাহ ধরে লেখা কয়েকটি কবিতার
পাণ্ডুলিপি ছিঁড়ে ফিপ্সি
হাওয়ায় উড়িয়ে দিই; আমার মুখমণ্ডলে
লেগে-থাকা কৃষ্ণচূড়ার ভগ্নাংশসমূহ
আমাকে কোনো আদিবাসীর
আদল দেয়। ক্রোধ
আমার হৃদয়কে ক্রমাগত পোড়াতে থাকে আর
আমি দিগন্তে দেখি তোমার মুখের উদ্ভাসন।আজ জানালার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছি
সূর্যোদয়ের চুম্বনের প্রত্যাশায়।
আকাশের চাঁদ মাঝে-মধ্যে
ঢাকা পড়ে মেঘের বোরখায়
আবার পর মুহূর্তেই প্রস্ফুটিত
মুক্ত চিন্তার মতো।কোনো কোনো গ্রন্থের হরফের অপ্রতিরোধ্য মিছিল
বদলে দিতে পারে সমাজকে।
সেরকম বহু বইয়ের সারাৎসার তুমি
নিজের অজ্ঞাতেই ধারণ করেছিলে।
আমার মনে পড়ে যায়, তোমার মৃতদেহ
১৯৭৫টি বুলেটে বিদ্ধ,
তোমার তর্জনী উদ্যত সূর্যোদয়ের দিকে।কেউ দ্যাখেনি সেই মৃতদেহ থেকে
বেরিয়ে এসেছেন এক অগ্নিপুরুষ,
যিনি ছাপ্পান হাজার বর্গমাইলের
প্রতিটি পথে হেঁটে যান
পাখি, জলধারা, রৌদ্র-জ্যোৎস্না এবং
মেঘমালাকে দীক্ষিত করতে
কৃষ্ণচূড়া আর স্বর্ণচাঁপা ছড়াতে ছড়াতে।
কৃষকের কুটির, বস্তির খোলার ঘর
মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাট, আত্মমগ্ন কবির দৃষ্টি,
ঝাঁঝালো দুপুরে মিছিলের শত শত মুখ
শনাক্ত করছে তোমাকে।তোমার নাম নতুন সূর্যোদয়ের মতোই
এক বিপ্লব, যার অন্ধকার-তাড়ানো
রুদ্র সৌন্দর্য দেখার প্রত্যাশায়
আমি দাঁড়িয়ে আছি জানালার খুব কাছে। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | রাগী মোষপালের মতো ধেয়ে আসছে
আকাশজোড়া মেঘদল আর সেই কবে থেকে
আমি হেঁটে চলেছি কাঁটাভরা পথে, চলেছি
অভীষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। অবিরত
রক্ত ঝরছে অতিশয় ক্লান্ত দুটো পা থেকে। বেয়াড়া
ক্লান্তি আর অমাবস্যা-হতাশার
চোখ রাঙানিতে জব্দ হয়ে ত্বরিত
এই গাছতলায় লুটিয়ে পড়লে বেঁচে যাই।অথচ একরোখা জেদ আমাকে ঠেলে দেয়
সামনের দিকে ঘুটঘুটি অন্ধকার, মেঘের
বাজখাঁই ধমক এক লহমায় অগ্রাহ্য ক’রে
এগোতে থাকি। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎপ্রবাহ আমাকে
পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। বিদ্যুল্লতাকে
ধন্যবাদ জানাতে থাকি প্রতিটি পদক্ষেপে।অকস্মাৎ আমার ব্যাকুল দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত
অনন্য প্রকৃতি-শোভিত তপোবন। আমার
দু’চোখ সঙ্গীতধারায় রূপান্তরিত অপরূপ
নক্ষত্রে যেন, কী এক আমন্ত্রণ আমাকে
পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় তপোবনের ভেতর। অভিভূত
দেখি একজন অনিন্দ্যসুন্দর তাপস
উপবিষ্ট উঁচু, দ্যুতি-ছড়ানো আসনে এবং
অদূরে তাঁর মুখোমুখি বেশ নিচু আসনে
বসে আছেন ক’জন তাপস। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি
তাকিয়ে থাকি সেই স্বর্গীয় দৃশ্যের দিকে।কারা যেন আমাকে সরিয়ে দিতে চাইলো
সেখান থেকে। উচ্চাসনে উপবিষ্ট তাপস
অঙ্গুলি নির্দেশে আমাকে এগিয়ে আসার সঙ্কেত জানিয়ে
দূরের একটি আসন দেখিয়ে দিলন। তাঁর ঔদার্যে
হতবাক আমি উজ্জ্বল সাহসে বললাম, ‘এই অধমকে আপনি
আপনার পদতলে ঠাঁই দিন গুরুদেব হে বিশ্বকবি।‘ অন্যান্য
আসনে উপবিষ্ট স্তম্ভিত কবিবৃন্দ চেয়ে থাকেন আমার দিকে,
চকিতে মুছে যায় দৃশ্য। আমি স্বপ্নহারা মেঘে ভাসতে থাকি! (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | এখানে নানানভাবে নানাজন কাটায় জীবন।
কেউ রাস্তা খোঁড়ে, কেউ টানে গুণ ধান ক্ষেত ঘেঁষে,
কেউবা আপিশে লেখে নথিপত্র, কেউ কেউ ঘোরে
উদাস প্রান্তরে বনবনান্তরে, কেউ গেরস্থালি
ভালোবেসে নীড়মুখী পাখির মতোন মনোযোগে
সাজায় সংসার, কারো দিন যায় গাছের ছায়ায়
পথপ্রান্তে কী একাকী। কেউ কেউ নিজস্ব বিবরে
স্বপ্ন দেখে বেঁচে থাকে, কেউবা বাঁচার মানে খোঁজে
মিছিলে সভায় আর নেতার ভাষণে। কারো সরু
দড়ির ওপর হেঁটে-যাওয়া, কারো শুধু বসে-থাকা।হরিদ্রাভ গ্রন্থাগারে কারো বই পড়ে কাটে বেলা,
আর নিরক্ষর কেউ জীবন বিশদ করে পাঠ
মেধাবী ছাত্রের মতো। কারো কারো চোখ এত শাদা,
তাদের দৃষ্টিতে গাছ শুধু গাছ, আকাশ আকাশ,
কেউ কেউ শূন্যতায় অকস্মাৎ দেখে ফেলে কত
সুনীল, সবুজ ঘোড়া, দ্যাখে ওরা নৌকো ফুল হ’য়ে
গহন নদীতে ভাসে। কেউ টিন আর সীসা নিয়ে
সর্বদা ঘামায় মাথা; কেউ গাছ থেকে, গর্ত থেকে
অথবা পাতাল থেকে শব্দ তুলে আনে নিরিবিলি।
এরকম নানা খাতে বয় নানাজনের জীবন।জীবনে ঔদাস্য কিছু, কিছু গূঢ় অস্পষ্টতা থাকে।
অস্পষ্টতা হেতু বাড়ে আকর্ষণ, আংটির মতোন
পরি কত রহস্যের সোনালির হলুদ সুতো, পড়ি
বেড়ালের চোখে স্মৃতি, মৃত প্রেমিকের সঙ্গে হাঁটিঅস্পষ্ট প্রহরে পারস্পর্যহীন কালের বাগানে।
স্বাপ্নিকের আস্তানায় নৃত্যপর প্রাচীন করোটি,
ওষ্ঠে কর্কশতা আর ধূলোবালি নিয়ে বেঁচে থাকি,
অথচ পাইনি খুঁজে অদ্যাবধি বাঁচার নিয়ম।
পরবর্তীগণ সবিস্ময়ে বলবেন কোনোদিন-
সর্বনাশ গোলযোগে কী করে যে বেঁচেছিল ওরা। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | উন্মত্ত বালক তার মাউথ অর্গানে দুপুরকে
চমকে দিয়ে সন্দেহপ্রবণ কিছু মানুষ ব্যতীত
দালান পুলিশ গাড়ি চকিত কুকুর অ্যাসফল্ট
রেস্তোরাঁকে বানাল দর্শক। ট্রাফিক সিগন্যালের
সবুজ বাতিটা ফের নতুন আশার মতো ঝল-
মল জ্বলে, কয়েকটি সম্ভ্রান্ত মোটর পাশাপাশি
হঠাৎ হরিণ হতে চেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে বুঝি
রোদচেরা সমুরের গমকে।
এভেন্যুর ফুটপাতে
উন্মত্ত বালক নেই, মাউথ অর্গান নাচে শুধু
দূরে-কাছে বাতাসের ঝঙ্কৃত সঙ্গতে। দুপুরের
রৌদ্রের বর্ষায় লোকগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠায়
প্রত্যেকটি মানুষকে মনে হল স্বপ্নে-ভেসে-ওঠা
দ্বীপের মতন, লুপ্ত স্মৃতির সন্ধানে চমকিত;
সুরের হীরকদ্যুতি ঝলসিত বুকের শ্লেষ্মায়
মগজের কোষে। ফুটাতে শুয়ে-শুয়ে সিংহ মুখো
কুষ্ঠরোগী আকাশে দু’চোখ রাখে, স্বপ্ন দ্যাখে, দ্যাখে
রঙিন পাখির কত নরম শরীর ভেসে যায়,
বাতাসে ছড়ায় রঙ। কখনো ভাবে না তারা কবে
ট্রেনের চাকার তলে কে রাখল দুঃস্বপ্ন-মথিত
মাথা তার, জানে শুধু অফুরন্ত ওড়ার আকাশ
বালকের অর্গানের সুরে ঝরে ত্রিতল দালানে,
রঙমাখা ক্লান্ত ঠোঁটে, নিঃশেষিত ফলের ঝুড়িতে
পথে বিট পুলিশের পোশাকের নিষ্প্রাণ শাদায়
মোটরের মসৃণ শরীর আর ব্যাংকের দেয়ালে
ফুটপাতে পরিত্যক্ত বাদামের উচ্ছিষ্ট খোসায়
পকেটমারের ক্ষিপ্র নিপুণ আঙুলে, তিনজন
গুণ্ডার টেড়িতে শুকনো-মুখ ফেরিঅলার গলায়।কুষ্ঠরোগী দ্যাখে তারও ক্ষতের পিছল রসে ঝরে
মত্ত বালকের অর্গানের সুর ভাবে এই সুর
পারে না গড়তে তার গলিত শরীরে ভাঁজে ভাঁজে
আবার নতুন মাংস শিল্পের অলীক রসায়নে?
হতে কি পারে না তার বিনষ্ট শরীর ওই দূর
আকাশের পাখিদের মতো ফের সহজ সুন্দর? (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | কাল তার ফাঁসি হবে। কেন হবে, তা সে জানে না এবং
জানে না বলেই অস্বস্তির পোকা তার
মগজের কোষে কোষে ঘোরে। পাঁজরে কী যেন পোড়ে,
ঘন ঘন বৃক্ক স্ফীত হয় আর
কখনো নিজেকে তার আনাজের বাকলার মতো মনে হয়
দেয়ালে ঠেকলে পিঠ।
এখন সে স্মৃতির ব্যাপক বেড়াজালে
আটকা পড়েছে। পেতলের বাসনের মতো ঝন্ ঝন্
বেজে ওঠে তৃতীয় এবং মনে পড়ে তার একদা দেয়ালে
লিখেছিল সে আবেগে কম্পমান; ‘ভুলব না কখনো তোমাকে’।
কাকে ভুলবে না?
অন্ধ সেলে দ্যাখে কবেকার বইয়ের পাতার
ফটোগ্রাফ থেকে
আসেন কী রাজসিক উঠে ক্ষুদিরাম; ফুচিকের
কাঁটাতারে বিদ্ধ টকটকে
গোলাপ-হৃদয় জ্বলে ওঠে অন্ধকারে। আর কিছু
পারস্পর্যহীন ছবি খেলা করে নির্ঘুম প্রহরে।মৃত্যু তার মাথার ওপর
অচিন পাখির মতো চক্রাকারে ওড়ে বারে বারে;
তুড়ি মেরে উড়িয়ে সে দিতে চায় ওকে,
অথচ নাছোড় পাখি নেয় না গুটিয়ে তার ছায়া
কিছুতেই সেল থেকে। হঠাৎ সে দ্যাখে
ধূসর পাজামা তার কখন যে ভিজে গেছে উদাস পেশাবে।
দেয়ালে ঠেকিয়ে মাথা বলে নিজেকেই,
তোমার অস্তিত্ব আজ, বুঝছ, হে, তুমুল নিঃশব্দ অট্রহাসি।আজ তার মনে হল-দরজায় মাধবীলতার
স্পন্দন, পাখির নাচ, পূর্ণিমার উচ্ছল চন্দন,
বিড়ালের চোখ, পাথরের মূর্তি,
রেকারি, কাচের গ্লাস, একটি মুখের রেখা, টুকরো
কথার এমন আকর্ষণ
কখনো জানেনি আগে। আজ অকারণ
বুকের ভেতরে তার যে কাঁদে একাকী
তার প্রতি এত ভালোবাসা এতকাল
কোথায় লুকিয়ে ছিল?কাল তার ফাঁসি হবে।
শেষ ইচ্ছা পূরণের ছলে কারুকে সে
দেখতে চায়নি, এমনকি
একটি অন্তিম সিগারেটও করেনি প্রার্থনা। শুধু
মনে-মনে চেয়েছিল দেখে নিতে পৃথিবীর রূপ
পুনর্বার। এখন সে কয়েদখানার
ঘুলঘুলি থেকে চুয়ে-পড়া
বখিল আলোয় রাখে ওষ্ঠ থরথর, যেন
চুমু খেল দয়িতার ঠোঁটে। (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | কোনো ঘুমন্ত রূপসীর স্মিত হাসির মতো
এই বিকেল। হাওয়া এক পাল
হরিণের চাঞ্চল্য। সুসজ্জিত মঞ্চে
শোভা পাচ্ছে সেমিনারের সুলেখা শিরোনাম।
নগরের আবাসিক সমস্যা’। সভাকক্ষ
আস্তে-আস্তে ভ’রে উঠলো শ্রোতায়,
যেমন উৎসবের দিন কোনো কোনো বিরাট ঘর
ছেয়ে যায় ফুলের স্তবকে। মঞ্চ
সভাপতি, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি
এবং বক্তাবৃন্দ; কেউ-কেউ প্রৌঢ়, কেউবা যুবা।মঞ্চস্থিত টেবিলে যুগল সৌখিন ফুলদানি আর এক গ্লাশ
টলটলে পানি। মঞ্চে উপবিষ্ট যাঁরা,
তাঁদের অধিকাংশের নিজস্ব ঘরবাড়ি আছে,
কারো-কারো একাধিক; একজন কি দু’জনের কোনো
বাড়ি আছে, অধিকাংশই ভাড়াটে বাড়ির বাশিন্দা;
কেউ কেউ থাকেন মেসবাড়িতে।নগরের আবাসিক সমস্যা বিষয়ে
বক্তারা একে-একে বক্তৃতা দিলেন সকলেই। বক্তব্য তাঁদের
শাঁসালো, যুক্তিশাণিত। মঞ্চে ক্ষনে ক্ষণে
টিভি ক্যামেরার চমক আর ঠমক। ক্যামেরাম্যান আর
স্টাফ ফটোগ্রাফারদের
হঠাৎ আলোর ঝলকানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সভাকক্ষ বারংবার
ঝলমলিয়ে উঠলো অজস্র কথার ফুলকিতে। কেউ কেউ
পাঠ করলেন দীর্ঘ প্রবন্ধ, তত্ত্বে তথ্যে ভুরভুরে।
প্রবন্ধ-পাঠকালীন কোনো-কোনো মুহূর্তে কেউ আড়চোখেদেখে নিলেন শ্রোতাদের মুখমন্ডলে
ভাষণের প্রতিক্রিয়া; কেউবা হাততালির স্থায়িত্বের মাপকাঠিতে
নিজের জনপ্রিয়তা করলেন পরখ। তাদের
সুভাষিবলীর মুখে পড়লো ফুলচন্দন।প্রধান অতিথি যখন ভাষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে
আসন ছেড়ে দাঁড়ালেন,
এগিয়ে গেলেন মাইক্রোফোনের দিকে, তখনই
বলা-কওয়া নেই, হঠাৎ একজন বালক
সবার অলক্ষ্যে শূন্য একটি চেয়ারে এসে
ব’সে পড়লো আনাহূত বিশেষ অতিথির মতো।তার পরনে ছেঁড়া শার্ট, জন্মের পর যতোগুলো বছর
সে পাড়ি দিয়ে এসেছে, ততো বিচিত্র তালি তার
ময়লা হাফপ্যান্টে চুল উসকো-খুসকো। রাস্তার ধারে
ধুলোবালির ঘর বানাচ্ছিলো। সে রাস্তাই
নিবাস তার; দিনে ঘুরে বেড়ায় এক রাস্তা থেকে
অন্য রাস্তায় নির্বাসিত নাবালক রাজার মতো,
কুড়ায় বাতিল কাগজ। কারো
বাগানের বেড়া ডিঙিয়ে তোলে না গোলাপ
বাজখাঁই গলার ভয়ে। রাতে ঘুমায়
ফুটপাথে, দোকানের বন্ধ দরজার কাছে, কিংবা
টিনশেডের আশেপাশে। কখনো-কখনো স্বপ্নে
সে প্রবেশ করে অভ্রের তৈরি গীতময় এক অট্রলিকায়।এখন সে আচমকা ঢুকে পড়েছে কৌতূহল বশে
এই সভাকক্ষে, প্রবেশাধিকারের
প্রশ্নটিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে। নাকি সে
নগরের আবাসিক সমস্যা বিষয়ক সেমিনারে
যাচাই করতে এসেছে, এই যে সাত বছর আগে
ঘুঁটেকুড়ানী এক নারীর অন্তর্গত লতাগুল্ম ছিঁড়ে
সভ্যতার উগরে-দেয়া উচ্ছিষ্ট হিশেবে
সে চলে এসেছে পৃথিবীতে, এ-ঘটনা কতোটা যুক্তিসঙ্গত
এবং সমীচীন! (ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | নিঝুম রাতের ঘরের স্তব্ধ কড়া জেগে ওঠে
আচমকা কার জোরালো নাড়ায়। ছুটে গিয়ে খুলি
বন্ধ দুয়ার। দৃষ্টিতে শুধু শূন্যতা ঝুলে
থাকে আর এক টিকটিকি খোঁজে রাতের ডিনার।খানিক পরেই ধীরে ফিরে আসি ঘরের ভেতর;
টেবিলে-জিরানো বোতলের পানি শুষে নিয়ে ফের
বিছানায় যাই। ঘুমোতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ
হয়ে আকাশের রূপ দেখে নিই। গাছের পাতার
নাচ চোখে পড়ে। বাতাসের কাছে মনে-মনে ঢের
কৃতজ্ঞবোধ করি সুকোমল সেবার জন্য।নির্ঘুম রাতে বহুরূপী ধ্যান-ধারণা কেবল
উঁকি দেয় মনে। জানালার দিকে চোখ মেললেই
নানা সময়ের নানা মুখ আর অনেক কাহিনী
জ্বলজ্বল করে, কিছু শুধু প্রায় ধূসর, মলিন-
মিছিলের মতো আসা-যাওয়া করে। শুধু বালোবেসে
সেইসব ছবি কাছে টেনে আনি, উড়াই নিশান।যদি কোনও দিন কেউ ক্ষেপে গিয়ে লাঠিসোটা নিয়ে
তেড়ে আসে তাকে শান্তির বাণী শুনিয়ে, ভুলিয়ে
যাতনা আমার যত্নে সত্যি বুকে নেবো টেনে,-
বলবো আমরা নিয়ত সবাই সবার জন্য (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | প্রায়শ ঘরেই থাকি, গৃহকোণে বসে বই পড়া,
কবিতা আবৃত্তি করা কিংবা লেখা, গান শোনা, কখনো জানালা
থেকে আকাশের নীল, ভাসমান মেঘ, বৃষ্টি ছপছপে পথে
কারো হেঁটে যাওয়া দেখা বড় ভালো লাগে।
আমি কারো সাতে পাঁচে নেই
ভেবে স্বস্তি পাই, কিন্তু ওরা লহমায়
আমার স্বস্তিতে
ধরায় ফাটল বারবার রাস্তায় টিয়ার গ্যাস
ছুঁড়ে, ছুড়ে বুলেটের ঝাঁক
অনিচ্ছায় শান্তিপোষ্য আমি হয়ে যাই দিশেহারা, ঘরছাড়া
এবং আমাকে ওরা ঠেলে দেয় দ্রোহী মিছিলের
উজ্জ্বল কাতারে।
এ শহরে আছে একজন অপসৃত সময়ের অপরূপ
সৌন্দর্য খচিত নারী, যার সান্নিধ্যের সুধা আজো
আমাকে মাতিয়ে রাখে, যার হাতে হাত
রেখে মনে হয় এরকম
ভঙ্গিমায় চিরকাল থাকা যায়, এমনকি ঘোর প্রলয়ের
তাণ্ডব উপেক্ষা করে! কিন্তু ওরা ধর্মঘটী ছাত্র শিক্ষকের, শ্রমিকের
মিছিলে ভীষণ মৃত্যু হানে,
এবং তখনই সুন্দরীর হাত থেকে কম্পমান বিচ্ছিন্ন আমার হাত
অকস্মাৎ তুলে নেয়
রক্তে লেখা অক্ষরে সজ্জিত এক তুমুল পতাকা।
আমিতো আমার কবিতাকে নিত্যদিন
গোলাপ বাগান করে রাখতে চেয়েছি। রাশি রাশি পরগাছা
যাতে সেই বিশুদ্ধ উদ্যানে জাঁহাবাজ
মাস্তানের মতো নষ্টামিতে মেতে না উঠতে পারে,
সেদিকে রেখেছি দৃষ্টি; কিন্তু হাজার হাজার ভারী বুটের আঘাতে
হয়েছে দলিত সে বাগান। কি আশ্চর্য, কোথাও দেখি না আর
গোলাপের চারা,
চতুর্দিকে বড় জায়মান কী ভীষণ্ণ ফনিমনসার বন! (হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | আমার চাদ্দিকে হায়েনার
হাসির মতন
অজস্র ফাটল আজ আমাকে ভীষণ
শাসন করছে, মনে হয়। মনে হয় কথাটা খামোকা বেশি
বলা হল; কবিতায় এ রকম বাড়তি কথার
ঠাঁই নেই, থাকা অনুচিত। বরং বললেই হতো
প্রকৃতই আমি ভয়ানক ফাটলসর্বস্ব এক
দালানের পুরোনো বাসিন্দা আশৈশব।আমার নিকট থেকে একে একে অনেকেই ক্রমাগত দূরে
সরে যাচ্ছ সম্প্রতি, যেমন
ঝড়-বাদলের গন্ধ পেয়ে হুঁশিয়ার
পিঁপড়েরা গা-ঢাকা দেয় সাত তাড়াতাড়ি
বলা নেই, কওয়া নেই, এই যে হঠাৎ
সটকে পড়ল যারা, ধ্যেৎ,
সুহৃদ অথবা
আত্মীয়স্বজনদের বিষয়ে সটকে পড়া এই ক্রিয়াপদ
ব্যবহার করা আদপেই সমীচীন নয়। তাঁরা
বেহদ্দ গর্হিত কাজ করেছে, একথা
কস্মিনকালেও আমি বলব না। কেউ
ফাটলসর্বস্ব দালানের পতনের রূঢ় শব্দ
শোনার আশায়
শেষ অব্দি অপেক্ষা করে না।অথচ সেদিনও
এক সঙ্গে গুলজার করেছি নরক,
পুরোনো সড়ক বেয়ে হেঁটে
গিয়েছি সকালে
অথবা বিকেলবেলা। সন্ধ্যায় খেলেছি দাবা, একই
টেবিলে খেয়েছি আর কখনো সখনো
দিয়েছি চুমুক গ্লাসে মস্তির ঝালরে ঝলসিত,
প্রত্যহ নিবিট হ্যাণ্ডশেক আর দু’বার দু’ঈদে
অন্তত করেছি কোলাকুলি খুব গোলাপী আহলাদে।অজস্র ফাটলময় দেয়ালে খিলানে চেয়ে থাকি
নিষ্পলক যখন তখন,
যেন করি পাঠ অতিশয় মনোযোগে
আমার নিজস্ব ভাগ্যলিপি। মাঝে মাঝে
মধ্যেরাতে ঘুরি দালানের
আনাচে কানাচে, তারপর ভয় নিয়ে শুতে যাই,
ভয় নিয়ে জেগে উঠি প্রত্যহ আবার।
লোকটা উটকো বড় আজব ছিটেল,
বলে কেউ; কেউ বা বানায়
গল্প কিছু লতাপতাসমেত বস্তুত-
এই দালানের নিচে নাকি
আছে সুপ্রাচীন গুপ্তধন, আমি যক্ষের মতন সর্বক্ষণ
রেখেছি নজর তাতে। নইলে এইমতো
বিপদ মাথায় নিয়ে কেউ কি এখানে করে বাস?সুদূর নীলিমা থেকে ঢ্যাঙা পোস্টম্যান অকস্মাৎ
নেমে আসে এবং আমার
হাতে গুঁজে দেয়
সুনীল নোটিশ এক, ভাষা যার অবোধ্য নিছক আর সেই
পোস্টম্যানটিকে কিছু জিজ্ঞেস করার
আগেই সে তার ব্যাগ দোলাতে দোলাতে মেঘদলে
ভাসমান, শাগালের ছবিতে যেমন।
ব্যাপারটা তবে দেখবার মতো। তাই,
নিজের সঙ্গেই আমি বোঝাপড়া করি বহুদিন
এবং নিজের অজান্তেই বারংবার
চমকে তাকাই, কাছে ধারে
সামান্য শব্দ হলেই, ভাবি এই বুঝি
হুড়মুড় করে সব দেয়াল খিলান ঘুণেধরা কড়িকাঠ
পড়ল মাথায়। সত্যিই তো
এই যে এখনো আমি অনেকের নিন্দামন্দ সয়ে
দিনরাত্রি এই ভয়তরাসের মধ্যে আছি, এর
রহস্য কোথায়? কেন আমি এই ফাটলের
সম্মেহন ছেড়ে অন্য কোথোও যাই না? কেন? প্রশ্ন
আপাতত একটাই। উত্তর আমার
জানা নেই; কেননা আমি তো এক নয়,
আমার ভেতরে আছে বহু বহুজন। তাদের কেউই
উত্তর খোঁজার জন্যে আমার মতই গা করে না। (আমার কোন তাড়া নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | শরীরের রঙ তার ধূসর কালচে, ধূত ব’লে
নাম ডাক আছে, লোকে তাকে মিহি সৌজন্যবশত
পক্ষী বলে, কেউ কেউ, রাশভারি, বস্তুত সতত
কাককে বায়স বলে করে সম্বোধন। কলরোলে
আসক্ত সে, আজন্ম সংগীত-ছুট, তবু খুব গুণী
গায়কের মতো ভঙ্গিমায় মাতে; কণ্ঠে তার, হায়,
মদির বসন্তদিন হয় না নন্দিত, নিরুপায়
ডেকে যায় ব্যর্থ মানুষের মতো, শুনি আমরা শুনি।ডেকে যায় ভোরবেলা, ধু-ধু দ্বিপ্রহরে কখনো বা
স্তব্ধ মধ্যরাতে ভুল সকালের উদ্দেশে ব্যাকুল।
ভাবে, তার আর্ত হৃদয়ের তন্ত্রী-ছেড়া স্বরে
নিমেষেই আশপাশে জেগে ওঠে নিরিবিলি শোভা।
আমার মগজে কাক ডাকে জপে কী সুন্দর ভুল-
বিপুল জ্যোৎস্নায় উড়ে চলে যায় ভুলের ভিতরে। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | তরুণ উজ্জ্বল তিনজন কবি গাঢ় সায়াহ্নকে
ঝাঁঝালো দুপুর করে আমার পড়ার ঘরে এসে
বলে, ‘ওরা আপনার দিকে ছুঁড়েছে বিস্তর কাদা
খোলা পথে শাঁসালো মণ্ডপে; আমরা তা কিছুতেই
আর মেনে নেবো না, জবাব দিতে চাই এই নোংরা,
ক্লিন্ন আচরণটির। স্পষ্টত ওদের চোখে ছিল
উষ্মা আর বেদনার ঈষৎ গোধূলি। আমি হেসে
কবিতা ঢেউয়ে ভেসে চকিতে উত্তর-আধুনিক।আমার পড়ার ঘরে তিনজন তরুণ কবির অস্তমিত
ক্ষোভ ভালো লাগে, জমে ওঠে দিব্যি ষড়জে নিখাদে
আলাপ এখনকার কবিতা বিষয়ে। ওরা নিলে
বিদায় ফুরফুরে মনে, উদার আকাশে মগ্ন হই,
নক্ষত্রপাড়ার গুঞ্জরণ শুনি, তার কথা মনে
পড়ে; ভাবি, কাদাতেই ফুল ফোটানো আমার ব্রত। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | খর রৌদ্রের নিথর প্রহরে
শ্রাবণের ঘন মেঘ দেবে বলেছিলে।
তৃষিত চোখের আর্তি ঝরিয়ে
চেয়ে থাকি দূর অসীম শূন্যে, নীলে।ঘন সমারোহে পুঞ্জ পুঞ্জ
মেঘের জটলা দূর আকাশের পাড়ে;
যেন একপাল কালো মেঘ তেড়ে
লাফ দিয়ে পড়ে শুভ্র মেঘের ঘাড়ে।হৃদয়ে মরুর বালি ওড়ে আজ,
দারুণ তৃষ্ণা রুক্ষ সত্তা জুড়ে।
ছায়া খুঁজে ফিরি পাথুরে মাটিতে,
কখন যে মেঘ বাতাসে গিয়েছে উড়ে।দুপুর-রৌদ্রে তোমার ছায়ায়
নিজের ছায়াকে সহযে মিলাতে চাই।
কোন্ সে আগুন শুষে নিয়ে গেছে
স্নিগ্ধ ছায়াকে-পড়ে আছে শুধু ছাই!হাজার যুগের প্রেমিকের কতো
বাসনা দগ্ধ হৃদয়ে বেঁধেছে বাসা-
সেই গুরুভার বই দিনরাত,
পথের ক্লান্তি ভোলায় ছায়ার আশা।গৌরাঙ্গীর দেহের বাগানে
চোখের লুব্ধ ভ্রমরের জয়গান।
শিরায় শিরায় সেতারের ঝালা,
রক্তের প্রতি কণা চায় মহাদান।জ্বলজ্বলে দুটি স্বর্ণ কুম্ভ
কানায় কানায় যৌবন-জলে ভরা।
জীবনের স্বরে ছলকিয়ে ওঠে,
সীমাহীন পথে সে-জল ক্লান্তিহরা!স্নান সেরে এলে কুন্তল ধারা
ঝরতো একদা গুরু নিতম্ব’ পরে।
কালিয়া আঁধার কনক চাঁদার
শরণ নিতো যে-তা-ও আজ মনে পড়ে!আমার প্রাণের খর বৈশাখে
মেঘে মেঘে আনো বিপুল বৃষ্টিধারাঃ
হৃদয়ের কূলে সিক্ত হাওয়ায়
কাশফুল হবে খুশিতে আত্মহারা।কতকাল আর কাটাবো বিষাদে
দিনরাত শুধু স্মৃতি সম্বল করে?
মাঝ মাঝে তাই বিচ্ছেদ ভেবে
বেহুঁশ বেতাল নামি নরকের ঘরে।দৈব দয়ায় বহুকাল পরে
হয়তো আসবে মিলনের মহাক্ষণ।
কিন্তু তখন কোন্ বনে, হায়,
হরিণ-ক্ষিপ্র তোমার সে যৌবন? (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | সকালটা ছিল যে-কোনও সকালেরই মতো। টাটকা মাখন রঙের রোদ,
ফুরফুরে হাওয়ায় গাছের গাঢ় সবুজ পাতার স্পন্দন, উঠোনে একটি কি দু’টি
ছোট পাখির ওড়াউড়ি, আমার ঘরকে চড়ুইয়ের নিজস্ব আকাশ বলে ঠাউরে
নেওয়া, দোতলার রেলিঙে শাড়ি, বাকরখানির ঘ্রাণ, রেডিওর গান, চা-খানার
গুঞ্জন, রিকশার টাং টাং শব্দ। আমার বেডসাইড টেবিলে ধূমায়িত চায়ের বাটি,
কাচের চুড়ির আনন্দ-ভৈরবী। কী যেন মনে পড়ছিল আমার, বহুদিন আগে যে
জায়গায় গিয়েছিলাম সেই জায়গার কিছু দৃশ্য, কোনও কোনও মুখ।
জায়গাটার নাম মনে পড়ছে না; কবে গিয়েছিলাম, তা-ও ঠিক মনে নেই।
বারবার মনে পড়ছে একটা বাগানের কথা, রঙ বেরঙের ফুলে সাজানো
মধ্যবিত্ত বাগান। বাগানে কি কেউ ছিল?ওরা চলেছে আল বেয়ে, ক্লান্তি পায়ে; ছায়ার মতো এগোচ্ছে ওরা শ্লথ গতিতে?
ওরা কারা? ওদের কি আমি চিনি? একজন বসে বসে ধুঁকছে, আঁকড়ে ধরেছে
আলের ভেজা মাটি। নোংরা নোখের ভেতর উঠে এসেছে কিছু মাটি, ওর চোখ
ঘোলাটে। সেই ঘোলাটে চোখে ভবিষ্যতের কোনও ছবি ছিল না, বাগানের
রঙিন স্তব্ধতা ছিল না, ছিল না ঝর্ণার পানির স্বচ্ছতা। সবার আগে যে হাঁটছিল,
সে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। ওর দৃষ্টি থেকে মুছে গেছে সকাল বেলার রোদ,
পাখির ডানায় ঝলসানি, ময়ূরের আনন্দিত পেখম। ওর ভবিষ্যতের ভাবনায়
রোদ ছিল না, মেঘের আনাগোনা ছিল। যে মেয়েটি ছেলে কাঁখে হাঁটছিল, ওর
একটা চুড়ি ভেঙে গেল হঠাৎ, টুকরোগুলো পড়ে রইল আলের এক পাশে।
মেয়েটির মনের ভেতর ওর ছেলের কান্নার দাগের মতো একটা দাগ খুব গাঢ়
হয়ে রয়েছে। ভাঙা বাবুই পাখির বাসার মতো তার সংসার অনেক দূরে
সমাহিত। উনুনের মুখ গহ্বর থেকে আর ধোঁয়া ওঠে না পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে,
‘গেরস্থের খোকা হোল’ বলে যে পাখি মাঝে-মধ্যে ডেকে যায়, সে হয়তো
বিধ্বস্ত ভিটের লাগোয়া গাছের ডালে এসে বসবে, কিন্তু দেখবে ত্রিসীমানায়
গেরস্থ নেই।সকালটা ছিল যে-কোনও সকালেরই মতো। টাটকা মাখন রঙের রোদ,
ফুরফুরে হাওয়ায় গাছের গাঢ় সবুজ পাতা স্পন্দন উঠোনে একটি কি দু’টি
পাখির ওড়াউড়ি। সকাল বেলা মধ্যরাতে রূপান্তরিত হয়ে এক লহমায়।
টেলিফোনে কার কণ্ঠস্বর? নিদ্রা-প্রভাবিত, স্বপ্ন-নির্ভর কণ্ঠস্বর। কিছুতেই
শনাক্ত করা যাচ্ছে না। আমি কি দরবারী কানাড়া শুনছি? সেই কণ্ঠস্বরে
নিঃসঙ্গতা, উদ্বেগ আর বিষণ্নতার অর্কেস্ট্রা। সেই কণ্ঠস্বর আমাকে পর্যটক
বানায়; আমি পাকদণ্ডী বেয়ে পাহাড়ে উঠি, জাহাজে চড়ে সাত সমুদ্র তের নদী
পাড়ি দিই, প্লেনে যাত্রা করি পূর্ব গোলার্ধ থেকে পশ্চিম গোলার্ধে, মরুভূমির
বালিয়াড়িতে সূর্যের চুম্বনে আমার ত্বক ঝলসে যায়, উত্তর মেরুর তুষার-
কামড়ে আমি জ্বরাক্রান্ত রোগীর মতো প্রলাপ বকি। সেই কণ্ঠস্বর বন্দি করে
আমাকে, আমার হাতে পরিয়ে দেয় ক্রীতদাসের কড়া। আমি কি প্রকৃত চিনি
তাকে?তাকে চিনি, একাল বেলার আকাশকে যেমন চিনি, কিংবা যেমন চিনি সন্ধ্যার
মেঘমালাকে-একথা বলার মতো সাহস সঞ্চয় করতে পারি না কিছুতেই। যদি
আমার ভুল হয়ে যায়! ভুল করবার অধিকার আমার আছে জেনেও আমি
নিজেকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখি। একটা পরাক্রান্ত হেঁয়ালিকে আমি
একনায়কত্ব ফলাতে দিই স্বেচ্ছায়। হেঁয়ালি মাকড়সার মতো জাল বুনতে
থাকে আমার চারপাশে, আমি জালবন্দি হই। মাঝে-মধ্যে চকচকে ছুরির মতো
ঝলসে ওঠে একটা ইচ্ছা-হেঁয়ালির অস্পষ্ট ঝালর সমাচ্ছন্ন টুঁটি আমি চেপে
ধরবে একদিন, যেমন ওথেলোর প্রবল কালো দু’টি হাত চেপে ধরেছিল
ডেসডেমোনার স্বপ্ন-শুভ্র গলা।আমি কি ভুল উপমার ফাঁদে পা দিলাম? আলোয় স্নান করতে গিয়ে কি অন্ধকার
মেখে নিলাম সমগ্র সত্তায়? আমার ভ্রূতে এখন স্বপ্নভুক, ক্রুদ্ধ একটা পাখি
ডানা ঝাপটাচ্ছে ক্রমাগত, আমার আঙুল থেকে উৎসারিত ফোয়ারা উদ্গীরণ
করছে আগুনের হলকা। আস্তে সুস্থে মৃতের বাগানে প্রবেশ করছি আমি; জানি
সেখানে কাউকে দেখতে পাব না, শুধু কারও কারও অনুপস্থিত উপস্থিতি নিস্তব্ধ
রাগিণীর মতো বেজে উঠবে হাওয়ায়, আমার শিরায়। পা ভারী হয়ে আসবে,
বিস্ফারিত হবে চোখ। কথা আমি কম বলি, যেটুকু বলি গলার পর্দা নিচু
রেখেই বলি। কিছু ছায়াকে দোসর ভেবে ওদের সঙ্গে কথা বললাম। মনে
হলো, অন্ধকার রাত্রির ফসফরাসময় তরঙ্গের মতো বয়ে গেল বহু যুগ।এইতো আমি এসে পড়েছি বিরাট এক অ্যাকোরিয়ামের কাছে। অনেক রঙিন
মাছ কেলিপরায়ণ সেখানে। কেউ সাঁতার কাটছে উদ্ভিদ ঘেঁষে, কেউবা ক্ষুধে
পিছল বল্লমের মতো ছুটে চলেছে নুড়ির দিকে। অ্যাকোরিয়ামের ভেতর মাছ
কি কুমারী থাকতে পারে কখনও? মাছগুলো আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিতে চায়
ওদের মৎস্যবৃত্তান্ত। ওদের অন্তর্জীবন পরতে পরতে যাতে যাতে মেলে ধরতে
পারি, সেজন্যে ওদের শরীর থেকে ওরা বিচ্ছুরিত হতে দিচ্ছে রহস্যময় সুর।
ওদের সন্ধ্যাভাষার দীক্ষিত করতে চাইছে আমাকে।
আমি লিখতে পারি, আমার কলমে অলৌকিকের ঈষৎ ঝলক আছে-একথা
ওদের বলে দিল কে? মাছগুলোর চোখ আমার দিকে? বিব্রত বোধ করলাম
আমি। আমি কি সেই কুহকিনীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হতে চলেছি, যার চোখ
ফসফরাসের মতো উজ্জ্বল আর চুল সামুদ্রিক শ্যাওলার মতো সবুজ? আমি কি
লিখতে পারব নতুন এক মৎস্য পুরাণ? ইতোমধ্যে একটি সোনালি মাছকে
আমি স্বৈরিতায় বলে শনাক্ত করেছি। না কি অ্যাকোরিয়ামের প্রতিটি স্ত্রী মাছই
স্বৈরিতায় নিপুণা আর প্রত্যেকটি পুরুষ মাছ অজাচারে পারঙ্গম? মাছগুলোর
জলকেলি দু’ চোখ ভরে দেখি, ওরা আমার ভেতর প্রবেশ করে সূর্যরশ্মির মতো,
আমি অ্যাকোরিয়ামের পাতালে চলে যাই, মাছ হই।এখানেই শেষ হতে পারত এই কথাগুচ্ছ, নামতে পারত এক বিবাগী নীরবতা।
অথচ বাবুই পাখির ভাঙা বাসার মতো একটি সংসার, ধুঁকতে-থাকা একজন
বৃদ্ধ, হারিয়ে যাওয়া সন্তানের খোঁজে প্রায়-উন্মাদিনী মা আমার ভাবনাকে
ভবঘুরে করে। একটা আচাভুয়া পাখি ডাকতে থাকে আমার বুকের সান্নাটায়।
সেই ডাক আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে কিছুক্ষণের জন্যে। আমার ঘুম আর
জাগরণের মধ্যে আছে যে বিরানা প্রান্তর, তার সুদূরতা আমাকে বলে ‘বাঁচো,
তুমি বাঁচো। (মেঘলোকে মনোজ নিবাস কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | প্রবহমান নদীতীরে একটি নয়নাভিরাম
বৃক্ষ নানাজনের হিংসার পাত্র হয়ে
মেরুদণ্ড সোজা রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো। গাছটিতে
এক ঝাঁক কোকিল মহানন্দে করতো বাস।ওদের গানের সুরে পার্শ্ববর্তী নদীর ঢেউ
উঠতো নেচে প্রায়শই। সহসা
একদিন কোত্থেকে ক’টি শকুন উড়ে এসে
জুড়ে বসে উৎপাতে উঠলো মেতে। কোকিলেরা ভড়কে যায়।মারমুখো শকুনদের হামলায় সবুজ গাছের নিচে
বয়ে যায় রক্তিম স্রোত, অনেক
কোকিলের লাশে ছেয়ে যায় ভেজা মাটি। তবে কি
বৃক্ষচূড়ায় কায়েম হলো শকুনের কর্তৃত্ব?তিন-চারবার সূর্য আকাশ থেকে উধাও
হওয়ার পর কোকিলের ঝাঁক গান গাইতে
শুরু করে নতুন প্রেরণায়। ওদের ডানা আর ঠোঁটের
ঝাপটায় শকুনেরা জখম-কলঙ্কিত
পাখা আর মাথা নিয়ে পড়ি মরি করে পালালো
দূরে অন্য কোনওখানে। কোকিলের গানে নাচে প্রফুল্ল নদী। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | বহুকাল থেকে দেখছি সুখ আমার বেশিদিন
সয় না। বালকবেলা আম্মার দেওয়া ইস্কুলের
টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে মহানন্দে দুলদুল ঘোড়ার
একটা রঙিন ছবি কিনেছিলাম। কিছুদিন না যেতেই সেটি কোথায়
হারিয়ে গেল, তার হদিশই পেলাম না আর। যখন আমি
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আব্বা আমাকে কফি রঙের একটি শেফার্স কলম
কিনে দিয়েছিলেন, পেয়ে কী-যে সুখী হয়েছিলাম; কিন্তু
পুরনো না হতেই সেটি চলে গেল পকেটমারের কব্জায়।গতকাল অনেকদিন পর সকালে টেলিফোনে গৌরীর
কণ্ঠস্বর শুনে কী-যে সুখ পেয়েছিলাম, কী করে বোঝাবো অন্য
কাউকে? আমার দেহমন হয়ে উঠেছিল উৎসবের আলোকসজ্জা।
দুপুরেই রিসিভার রাগী কুকুরের মতো গরগর আওয়াজ
করছিল, কিছুক্ষণ পরেই স্তব্ধ। হায়, এমনই বরাত আমার, ক’দিন
তার সঙ্গে কথা বলতে পারবো না, দেখা হওয়ার পথও বন্ধ। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | কে তুমি কে তুমি বলে আমার হৃদয় হ’য়ে যায়
আরক্ত চিৎকার এক। সেই বেলফুল ফুটে আছে
চুলের চুড়ায় আজো কী প্রফুল্ল। রাগমালা নাচে
সতত অস্তিত্বময়, একটি নিমেষ স্তব্ধতায়
হয়ে গেছে চিরকাল। অনেক দুরের নিরালায়
যে ফাল্গুনে মধ্যরাতে দরবারী কানাড়ার কাছে
সমর্পিতা, তার চক্ষুদ্বয়ে স্মৃতির মন্তাজ বাঁচে,
না কি সে নিজেই স্মৃতি অনেক মনের নীলিমায়!তোমার পুরোনো ছবি দেখে ভাবি, সত্যি এই তুমি
সে-তুমির কাছ থেকে কতদূরে এসে আজ একা
আঁধারে দাঁড়িয়ে আছো; পারাপার কোথায় বিলীন;
আশ্রয় আঁধিতে লুপ্ত, দারুণ বিরূপ এই ভূমি।
কখনো আবার, কথা ছিলো, আমাদের হবে দেখা-
এসেছি দুর্যোগে তাই তোমার কাছেই দ্বিধাহীন। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | আমার চোখে এত পানি নেই যে,
এই দুরন্ত আগুন আমি নেভাতে পারি;
আমার লেখার টেবিলে এত জায়গা নেই যে,
নরখাদক-তাড়িত শত মানুষকে দেবো ঠাঁই।যে শব্দগুলো আমার দিকে আসছিল
প্রজাপতির মতো উড়ে,
সাঁতার কেটে মাছের মতো, তারার স্রোতের মতো,
মৌমাছির মতো, ওরা ভীষণ পুড়ে যাচ্ছে আগুনে।শব্দের শ্মশানে দাঁড়িয়ে, চিত্রকল্পের গোরস্তানে বসে
আমি কেবল ছাই ওড়াই, ছিঁড়ি ঘাস।
আমার শব্দগুলোর গলায় জল্লাদ
বেধড়ক ছুরি চালায়; ফিন্কি দিয়ে রক্ত ছোটে
উপমার বুক থেকে। আমার শব্দাবলী
খোলা আকাশের নিচে একবস্ত্রে হি হি কাঁপছে
উপকূল-ঘেঁষা ঘরপোড়া মানুষের মতো শীতের
দাঁত বসানো রাতে প্রাণভয়ে।এ কোথায় বাস করছে আমার শব্দেরা?
ওদের মাথার খুলিতে দুঃস্বপ্ন ঠাসা,
ওদের চেতনা সারাক্ষণ অপঘাত-শানিত
ওদের চোখে ভেসে ওঠে বারবার ক্রুশকাঠ এবং
ওরা চোখ খুলতে ভয় পায়, পাছে দেখে ফেলে
নিরপরাধ লাশ, ধর্ষিতা নারীর উলঙ্গ শরীর।আমার শব্দাবলী জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে,
ক্ষুধার্ত আর ভোজতৃপ্তদের মাঝখানে,
ভোর ও সন্ধ্যার মাঝখানে,
হত্যাযজ্ঞের উন্মত্ত উল্লাস আর
শান্তি মিছিলের মাঝখানে স্তম্ভিত,
চোখ রগড়ায়, শান্তির গান গাইতে গিয়ে
দাঙ্গাবাজদের পায়ের তলায় পড়ে
অব্যক্ত থেকে যায় সময়হীনতায় (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | টেবিলে জমাট মেঘ এক খণ্ড যেন স্বপ্নে বুঁদ,
কিংবা অভিশপ্ত গ্রীক দেবীদের কেউ সারাক্ষণ
মুক্তির প্রহর গুণে গুণে ক্লান্ত, ঘুমে অচেতন,
এক্ষুণি উঠবে জেগে এবং সত্তায় তার হবে
মুঞ্জরিত ক্ষণে ক্ষণে বহুবর্ণ গভীর সংগীত।
টেবিল তরঙ্গ হয় বারে বারে মেঘের প্রভাবে।যখন বুলাই হাত মেঘখণ্ডে, তোমাকে প্রবল
মনে পড়ে। টেবিলের স্বপ্নিল মেঘের অন্তরালে
আলোড়নকারী কোনো কণ্ঠস্বর আছে জেনে প্রতি
মুহূর্ত অপেক্ষা করি, কখন তোমার অস্তিত্বের
সুর হবে গুঞ্জরিত, কখন এ ঘর পুনরায়
ইডেনের লতাগুল্মে যাবে ছেয়ে, দূর সমুদ্রের
সফেন উল্লাসে হবে উচ্ছ্বসিত আর ভেনাসের
পদচ্ছাপ উঠবে জেগে রেণুময় নিঝুম মেঝেতে।টেবিলে জমাট মেঘ বেজে ওঠে স্বপ্নে, জাগরণে।
সর্বদা কম্পিত হাতে তুলে নিই মেঘ, প্রতিবার
প্রতিহত আমি শব্দহীনতায়, জব্দ হই খুব।
তবে কি ওঠেনি বেজে মেঘপুঞ্জ? তবে কি মিথ্যেই
গভীর নিদ্রার হৃদে পড়ে টোল? শিরায় শিরায়
কেন তবে সূর্যোদয় আগণন, কেন ঝাঁক ঝাঁক
গাংচিল সহসা ওড়ে বুকের ভেতরে বারংবার?
আমার নিজস্ব হাড় কেন বেহালার মতো বাজে?টেবিলের এক খণ্ড মেঘে আছে তন্দ্রিল সিম্ফনি
অলৌকিক, বুঝি তাই সুরস্নাত এ ঘর আমার।
দেখেছি কখনো টেবিলের মেঘপুঞ্জে দ্রাক্ষালতা
ক্রমবর্ধমান আর রূপোলি ঝালর চমকায়
ঘন ঘন, কখনো বা মেঘখণ্ডে মৃতকে আরেক
মৃতজন ভীষণ জড়িয়ে পড়ে থাকে স্তব্ধতায়
যমজ ভায়ের মতো। কখনো আবার সামুদ্রিক
মাছের কংকালে গড়া উদ্যান সেখানে জেগে ওঠে।ইদানীং ভয়ে ভয়ে থাকি-যদি এই মেঘখণ্ড
মরাল সংগীত গেয়ে শেষে ডুবে যায় স্তব্ধতায়,
যদি অস্তরাগময় হয়, যদি মৃত শশকের
মতো একা পড়ে থাকে এক কোণে, তাহলে কী হবে? (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | চিন্তামূলক |
শামসুর রাহমান | সনেট | পাঠাওনি তুমি আজ কোনো পাখি আমার নিকট
কবির খবর দিতে। যে পাখিটা পুষছো হৃদয়ে
দীর্ঘকাল, রেখেছ আড়াল করে তাকে, যাচ্ছে বয়ে
দিনরাত, কার পদাঘাতে ভাঙলো মঙ্গলঘট?
তোমার অশান্ত মন সর্বক্ষণ বইছে পাথর,
এভাবে কি শ্বাস-প্রশ্বাসের সূক্ষ্ম, সাবলীল খেলা
চালানো সম্ভব অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া? স্নিগ্ধ বেলা
বড়ো ক্ষণস্থায়ী, চতুর্দিকে জীব বেদনা-কাতর।তোমার বেদনা আরো বাড়াতে চাই না বলে থাকি
চুপচাপ, একা-একা সই বিচ্ছেদের স্বৈরাচার।
ফুসফুসে বীজাণুর হট্রগোল অন্তরালে চলে আর
ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসে খাঁচা; কবে প্রাণ-পাখি
উড়ে যাবে, কে জানে এ ভাবে? তাই বলি, এসো তবে
আমরা দু’জন বাঁচি বেদনার নিঃসীম গৌরবে। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | দুপুরবেলা খেলাচ্ছলে কোথায় যে যাচ্ছিলাম
আস্তে সুস্থে, কী খেয়াল হলো
হঠাৎ ঢুকে পড়লাম
স্টেডিয়ামের বইয়ের দোকানে, সেখানেই
দেখা তোমার সঙ্গে। নিমেষে দুপুরের অধিক ঝলোমলো
হয়ে উঠলো দুপুর; তোমার চোখে চোখ পড়তেই
ভাবি, অনন্তকালের রঙ কি শাদা
পায়রার মতো? নাকি সমুদ্রের জলরাশির মতো
নীল? অনন্তকাল কি অপরূপ তালে-বাঁধা
কোনো ধ্রুপদী নাচ? সম্ভবত
শস্যের আভাস-লাগা নিঃসীম প্রান্তর, এ-কথা
মনে হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিপথে চকিতে
দুলে ওঠে স্বপ্ন-জাগানো এক লতা
কী নিবিড়,
সাইনবোর্ড, ম্যাগাজিন, বইপত্র, ভিড়
মুছে যায়; ঝালর কাঁপে, অকাল বসন্ত আসে অস্তিত্বের ভিতে।নিজেকে প্রশ্ন করি, যা ঘটলো এই মুহূর্তে
আমার মনে থাকবে চিরদিন? আর
তোমারও কি পড়বে মনে বহুকাল পর এই সাবেকি
ঘটনা, যখন তুমি অন্ধকারে
ঘরে একলা শুয়ে-শুয়ে ক্যাসেট প্লেয়ারে শুনবে পুরোনো গান
কোনো বর্ষাকোমল রাতে? কে জানে
হারিয়ে যাবে কিনা এইসব কিছুই? শুধু গুণীর তান
হয়ে বাজবে মন-কেমন-করা স্তব্ধতা বিস্মৃতির ভাটার টানে!তোমার চোখ হলো ওষ্ঠ, ওষ্ঠ চোখ,
আমি একটা বইয়ের পাতা ওল্টানোর ভান করে আনাড়ি
অভিনেতার ধরনকেই, যা হোক,
স্পষ্ট ক’রে তুললাম নিজের কাছে। সাত তাড়াতাড়ি
হাল আমলের একজন তুখোড় কবির
হৃৎপিণ্ডের ধ্বনিময়, বুদ্ধির ঝলকানি-লাগা বইয়ের দাম
চুকিয়ে তুমি আরো একবার গভীর
তাকালে আমার প্রতি। নিজেকে এগোতে দিলাম
আকাশ থেকে ডাঙায় নেমে-আসা
ছন্নছাড়া পাখির ধরনে। কথা বলবো কি বলবো না,
এই দ্বিধার ছুরি চলতে থাকে বুকের ভেতর। আমার ভাষা
যেন সেই কাফ্রি, যার জিভ কেটে
নেয়া হয়েছে, অথচ কথার ঝালর বোনা
হতে থাকে অন্তরে। দুপুরে অমাবস্যা ছড়িয়ে তুমি হেঁটে
গেলে করিডোর দিয়ে, মার স্বপ্নকে ফিকে
করে চোখের আড়ালে,
যেমন মল্লিকা সারাভাই যান খাজুরাহোর মন্দিরের দিকে
স্মৃতিতে জ্যোতির্বলয় নিয়ে গদ্যকবিতার চালে। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | সেই কবে থেকে লিখছি কবিতা, তবু হামেশাই
ভীষণ আটাকা পড়ি হতাশায় ঊর্ণাজালে।
কখনও-কখনও এমনও তো হয়, একটি কবিতা
মাঝপথে এসে স্মৃতিহীন ধুধু চড়ায় ঠেকে।মগজের কোষে, শিরায় শিরায় জাগে ক্রমাগত
গোধূলি বেলায় প্রাক্তন কত প্রতিধ্বনি।
দূরের পাহাড় থেকে ভেসে আসে দিশেহারা কোনো
মেষপালকের আব্ছা ব্যাকুল কণ্ঠস্বর।কখনও-কখনও শুরুতেই বাজে তালকানা সুর,
যেন সরগম কখনও আমার হয়নি সাধা
চিত্রকল্প পাথরের ভাঙা মূর্তির মতো
ঘর কুয়াশায় কেবলি ফোঁপায় হাওয়ার স্বরে।এরকম ঘটে, দেখি চিরচেনা গলিটার মোড়ে
আবর্জনার টিলাকে ছুঁয়েছে নীলিমা-চেরা
রঙধনু আর হাড়ের বাগানে পথ ভুলে ঢোকে
পঙ্গু হরিণ। অন্ধ রাজার ভাঙা বেহালা।ছেঁড়া কাঁথাটায় আশ্রয় খোঁজে রাত তিনটের
নিম উর্বশী, বেহেড মাতাল মধ্যরাতে
নিজের বমিকে মণিরত্নের ঝলক ঠাউরে
উলঙ্গ পথে পড়ে থাকে একা অনাশ্রয়ে।নিঃসর্গ আজ প্রলাপ বকছে,; ইঁদুরে ছুঁচোয়
ভরেছে শহর, গ্রাম ডুবে যায় বানের ক্রোধে।
ঘোর উন্মাদ রাজার মতন হাসে অবিরত
অত্যাচারের সেয়ানা, দাঁতাল অস্ত্রগুলো।এসব দৃশ্যাবলির আড়ালে যেসব দৃশ্য
স্থাপত্য হয়ে করছে বিরাজ ইতস্তত,
তাদের কিছুটা বাক্বিভূতির ছোঁওয়া দেবো বলে
ভুরুতে চন্দ্রকলা নিয়ে জাগি দীর্ঘরাত।কিন্তু আমার ব্যর্থতা শুধু শাদা কাগজের
খাঁ-খাঁ বুক জুড়ে বারবার জোরে বসায় নখ।
অন্ধ পাখির সঙ্গে এখন বসে আছি ঘরে
বাক্য খরায়; নগ্ন, তোতলা দেবতা যেন। (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | ধুর্তামি, ভণ্ডামি আজ প্রবল বিগ্রহ। অবেলায়
কাদায় ডুবেছে চাকা। একে একে অনেকে স্খলিত,
দিশেহারা; অবশেষে তুমিও কি হবে নিমজ্জিত,
হায়, চোরাবালিতেই? খুঁজবে আশ্রয় সাহারায়?
এখন অপ্রতিরোধ্য ধ্বংসের বিপুল কিনারায়
ছুটছে লেমিং গুলো; সুচতুর শিকারী হারপুন
দিচ্ছে গেঁথে মুক্তিকামী ভেসে-ওঠা পিঠে কী নিপুণ;
ডোবে দেশ ক্রমশ কৃত্রিম আধ্যাত্মিক ধোঁয়াশায়।কফিন কবর ডাকে প্রতিদিন কোকিলের স্বরে,
অথচ এগুতে হবে ঝেড়ে ফেলে সব পিছুটান।
খ্যাতির বাইজী খুব লাস্যময়ী ঢঙে টানে আর
মূর্খের বন্দনা ফিঙে হ’য়ে নাচে, মস্তির দোকান
হৈহুল্লোড়ে ভরপুর। দুর্বিষহ হতাশার ঘরে
ঠাঁই পাই; গোলক ধাধাঁয় চোখে দেখি অন্ধকার। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | তুমিতো যাবার আগে বিবর্ণ রোগীকে চমৎকার
প্রেসক্রিপশন আর কিছু পথ্য দিয়ে গেলে হেসে,
অবশ্য তুমি তা আন্তরিক উষ্ণতায় ভালোবেসে
করেছ; স্বীকার করি। মনে পুঞ্জ পুঞ্জ অন্ধকার
মেঘ যদি ঘনায়, তা হলে যেন ক্যাসেট প্লেয়ার
নিমেষে চালিয়ে দিই, রবীন্দ্রনাথের গানে ভেসে
যাই কিংবা ‘শেষের কবিতা’ শুনি নিভৃত আবেশে
ইত্যাদি বলার ক্ষণে তুমি ছিলে নিজেও আঁধার।ইচ্ছে করলেই কেউ বেদনার নিষ্করুণ চাপ
থেকে মুক্ত হতে যে পারে না, এই সত্য সুনিশ্চয়
তোমার অজানা নয়। মানি, শিল্প প্রলেপ বুলিয়ে
মনোভাব কিছুটা লাঘব করে; দহমনের তাপ
অত্যন্ত প্রখর হলে শিল্পকে হার মেনে নিয়ে
ব্যর্থতার গহ্বরে প্রস্থিত মুখ লুকাতেই হয়। (তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | হৃদয় তোমার অপরাধ নিয়ে কানাঘুষো চলে
নানান পাড়ায়, কলোনির ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে, অপবাদ
দেয় অনেকেই, কারো কারো মনের জ্বলুনি বেড়ে
যায়, তেড়ে আসে মাস্তানেরা আর প্রকাশ্যে শাসায়
কেউ কেউ। কিছু তোমার বোধগম্য নয়, যদি
বলো, কারো হবে না বিশ্বাস, কেউ ছাড়বে না পিছু,
উপরন্তু চাঁই যারা, তারা তোমাকে সর্বদা মাথা
নিচু করে থাকবার দেবেন নির্দেশ। শেষমেশ
জলচল বন্ধ হবে; ক্রমে ‘ওর নির্বাসন চাই’
বলে স্লোগানের ধুম পড়বে রাস্তায় পুরো দমে।আকাশে ফুটলে তারা বাগানে রক্তজবা,
হে হৃদয়, তোমার দু’চোখ জ্বলে ওঠে; অকস্মাৎ
কোনো তরুণীর মুখ দেখে শিরায় শিরায় জাগে
ঢেউ, তীব্র অনুরাগে তুমি পুড়ে যেতে যেত গান
গাও দীপকের সুরে-এটাই তো কসুর তোমার,
যতদূর জানি; নাকি খুব একা-একা থাকে, তাই
বরাদ্দ তোমার জন্যে কাঠগড়া! যেন সমাজের
ভরাডুবি তোমার সকল কাজে ভর করে আছে!
নিজের ভেতর থেকে কস্মিনকালেও মুছে যেতে
পারো না বলেই ক্রুদ্ধ তর্জনীর হয়েছ শিকার। (না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | সে-রাতে আমার ঘরে এক ঝাঁক উৎফুল্ল জোনাকি
বললো এসে-একটি কবিতা দিতে এসেছি তোমাকে।
অন্তর্হিত জোনাকির পরে একটি বাদুড় খুব
আনন্দে ঘনিষ্ঠ হয়ে কড়িকাঠে জানালো সস্নেহে-
একটি কবিতা দিতে এসেছি তোমাকে। অনন্তর
একজন মহিলার মুখ জানালায় ফুটে ওঠে,
নীলিমানিমগ্ন সুর তার ভাসে, যেন সমুদ্রের
ফেনাময়ঃ একটি কবিতা দিতে এসেছি তোমাকে।সেই স্বর ডুবে গেলে কতিপয় প্রাচীন কংকাল
কবরের মাটি ফুঁড়ে, ঘরের দেয়াল ফুঁড়ে এসে
বললো গাঢ়ঃ একটি কবিতা দিতে এসেছি তোমাকে।
অথচ শব্দের দূত ওড়ায়নি তখনো নিশান,
তখনো অদৃশ্য ওরা প্রেতলোকে, জীবাশ্মের মতো
স্তব্ধ, আমি প’ড়ে থাকি এক কোণে, ব্যর্থ অসহায়। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | নিদ্রার স্থাপত্যে ধীরে হাত রাখে স্বপ্ন, রেশমের
স্বরে কথা বলে, আমি পড়ার টেবিলে-
রাখা মধ্যযুগের কাব্যের ছন্দমিল
আর ব্যালাডের সঙ্গে কথা বলি, নিজের সঙ্গেও মাঝে-সাঝে।আমি গুটি কয় তাজা রুটি, এক পাত্র মদ আর
বাগানের গোলাপকে সুখস্বপ্ন দেখাতে চেয়েছি
বার বার; হাতের দশটি আঙুলকে
নিভৃতে বানাই মরূদ্যান, পায়ের গোড়ালি হয় ঝর্ণাধারা।সন্ধ্যাকে পেছনে রেখে শ্রান্ত মুসাফির চলে আসে
সরাইখানায়, দু’ভুরুর মাঝখানে চাঁদ ওঠে,
যেন ছদ্মবেশী ক্ষত। নিজেকে মানিয়ে নেয় পোকামাকড়ের
পছন্দের ডেরায়, পতঙ্গ পুড়ে যায় অগ্নিশিখা ভালোবেসে।নির্বাসিত রাজপুরষের মতো একা-একটা ঘুরি,
কখনো-বা ভুল পড়ে চলে যাই। বিশ্বস্ততা কাঁটার মুকুট
পরে হাঁটে কায়ক্লেশে, শতাব্দী পেছনে পড়ে থাকে;
স্মৃতি যেন উটের পায়ের চিহ্ন মরুর বালিতে।প্রতীক্ষার সময় ফুরায়; যার উপস্থিতি এখনো কুয়াশাবৃত,
তার কণ্ঠস্বর অতীতের শ্লোক আওড়ায়।
কিছুই পড়ে না মনে, জানি না চোখের পাতা কেন এই মূঢ়
বেঁচে-থাকা ধরে রাখে ঈষৎ কম্পনে? (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | কবিতাকে কেউ ভাবে জুঁই বেলী গোলাপ
কিংবা সেরকম কোনো ফুল
ডালে সাজানো
কবিতা কারো চিন্তায় আপেল আলুবোখারা
নাশপাতি কামরাঙা সুগন্ধি আম
কিংবা এ ধরনের কোনো ফল
সাফ সাফ বলেই ফেলি
এমন ভাবনা আমাকে পারে না বানাতে বশম্বদকবিতাকে কেউ দোয়েল বুলবুল কোকিল
ইত্যাদি ভেবে সুখী হয়
কেউ কেউ ধরে নেয় কবিতা
রূপালি মাছ ছাড়া কিছু নয়আহা শোনোই না
এমন কোনো ধারণার মোসাহেব আমাকে ভেবো নাকেউ কবিতাকে এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে-থাকা রূপসীর আদলে
ভাবতে পারলেই খুশীতে ডগমগ
জ্বি হ্যাঁ একথা সত্যি
এমন ভাবনা আমার মাথায় উপর ছড়ি ঘোরাতে অক্ষমকবিতাকে কেউ রসকদম কাঁচাগোল্লা
কেউ জিলিপি অথবা বাতাসা মনে করে
কেউ কেউ মুর্গীর রোষ্ট নুডলস শুটকির ভর্তা ভাবে
কেউ কেউ ঠাউরে নেয় কৌটোর সার্ডিন
কবুল করি এরকম কোনো কিছু
বিলকুল না- পছন্দ আমার
কবিতায় গল্প বলার ধরন অথবা
উপমা চিত্রকল্পের চর্বিতচর্বণ নারকেলের ছিবড়ের মতো
বিষয় স্যাঁতসেঁতে আধ্যাত্মিকতা ন্যাকা ছলাকলা
ভড়কে-দেওয়া আঙ্গিকের বুজরুকি কঙ্কে পায় না আমার কাছেকবিতা আমার হৃৎপিন্ড ছিঁড়ে চাঁদি ফুঁড়ে
বেরিয়ে আসা লাভাপ্রতিম কিছু
বলা যেতে পারে উত্তরবঙ্গের গোরুর গাড়ির চাকা
যার গায়ে বহু দূরত্ব ধুলো কাদা গাড়িয়াল ভাইয়ের ঘামের দাগবলেতো ফেললাম পষ্টাপষ্টি
কিন্তু মাছের কাঁটায় মতো কী একটা বিঁধছে মনে
আসলে কবিতা লোহার খাঁচায় আটকানো এক জলকন্যা
সমুদ্রে প্রত্যাবর্তনের জন্য লেজ আছড়াচ্ছে লাগাতার (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | আমি তো বিদেশী নই, নই ছদ্মবেশী বাসভূমে-
তবে কেন পরিচয় অন্ধকার ঘরে রাজা, কেন
দেশের দশের কাছে সারাটা জীবন ডুগডুগি
বাজিয়ে শোনাব কথা, নাচাব বানর ফুটপাতে?
কেন তবে হরবোলা সেজে সারাক্ষণ হাটে মাঠে
বাহবা কুড়াব কিংবা স্টেজে খালি কালো রুমালের
গেরো খুলে দেখাব জীবন্ত খরগোশ দর্শকের
সকৌতুক ভিড়ে? কেন মুখে রঙ মেখে হব সঙ?না, তারা জানে না কেউ আমার একান্ত পরিচয়
আমি কে? কী করি সারাক্ষণ সমাজের চৌহদ্দিতে?
কেন যাই চিত্রপ্রদর্শনী, বারে, বইয়ের দোকানে,
তর্কের তুফান তুলি বুদ্ধিজীবী বন্ধুর ডেরায়?
না, তারা জানে না কেউ।অথচ নিঃসঙ্গ বারান্দায়
সন্ধ্যা, এভেন্যুর মধ্যরাত্রির স্তব্ধতা, সার্কাসের
আহত ক্লাউন আর প্রাচীনের অতন্দ্র বিড়াল,
কলোনির জীবনমথিত ঐকতান, অপ্সরীর
তারাবেঁধা কাঁচুলি, গলির অন্ধ বেহালাবাদক
ব্রাকের সুস্থির মাছ, সেঁজার আপেল জানে কত।
সহজে আমাকে, জানে কবরের দুর্বিনীত ফুল। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | দেবদূতদের প্রিয় ছিল, বলা যায়, সেই
বন, ওরা ওড়াতেন রঙিন বেলুন
মাঝে-মাঝে বনের ভেতর। বলতেন, ঈশ্বর দেখুন
কী রকম সাজিয়ে রেখেছি এই
বনরাজিনীলা। তারপর
পরস্পর
হাত ধরে গোল হয়ে নাচে মেতে খানিক সময়
দিতেন কাটিয়ে
বস্তুত স্বপ্নের ঘোরে। আনন্দ অক্ষয়
ভেবে ছায়াদের নিয়ে
ইন্দ্রিয়বিলাসে মগ্ন হতেন হ্রদের তীরে। কেউ
কেউ অবসাদে জলে ঢিল ছুড়ে জাগাতেন ঢেউ।একদিন গোধূলি বেলায়
যখন অরণ্যচারী কিছু প্রাণী ছিল মেতে মিথুন-খেলায়,
অকস্মাৎ সেই বন আগুনের ঢল
কী বাপক এল নেমে! লতাগুল্ম, গাছপালা, জল,
পশুপাখি আগুনের তাপে উবে যায় ক্রমান্বয়ে,
সবাই প্রলয়াভাসে ভয়ে
ছোটে দিশেহারা, দেবদূতগণ চকিতে উধাও; দাবানলে
জ্বলে শুধু জ্বলে
চতর্দিক। এখন সেখানে আপাতত
নেই কিছু ভোজ্য কিংবা পেয়।
কেবল এটি আর্ত পাখি ধৈর্য ধরে করাচ্ছে স্নেহার্দ্র স্নান ক্রমাগত
সুর ঢেলে দগ্ধ বনস্থলীটিকে ভস্মীভূত হবে সে জেনেও। (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | অজানা তোড়ে, কিসের ঘোরে মেঝেতে টগবগানো ঘোড়া, কেশর
কালো মেঘ, ফাঁপানো, শ্যাম্পু- করা চুল, খুরের ধাক্কায়
কফিন স’রে যায় এক কোণে, বুনো নিঃশ্বাস।
হকচকানো কবি চেয়ার-ছাড়া, পাণ্ডুলিপির বিকিরণ।কী ক’রে ঘোড়টা ঘরে? কে পাঠালো? কবির চোখে
তখনও স্বপ্নের আঠালো রেশ। অন্যমনস্কতায়
ওষুধের শিশি কাটা মুণ্ডুর মতো
গড়ায়; হস্তধৃত পাণ্ডুলিপি থেকে সদ্য কবিতার উকিঝুঁকি।কবিতা কৌতূহলী শিশু, এরকম তাকায় ঘোড়ার
দিকে; কফিনের উদ্দেশে
অশ্ব-দৃষ্টি, ঝুঁকে থাকা। কবির বুকে তোলপাড়। এ কেমন
কাণ্ড কারখানা? কফিন কে এনেছে এখানে? কেন?খেলনা তো নয়, জীবনের উষ্ণতা টান টান চকচকে
চামড়ায়। কী খাদ্য দেবো তাকে, দণ্ডায়মান
কবিকে নিজেরই প্রশ্ন। ভাঁড়ারে
অনেক কিছুর মতোই ছোলা নেই, খড় বিচালি অবান্তর।‘তোকে খাবো’ ঘোড়া বলে। কবি ভড়কানো,
পেছনে হটে, দেয়ালে পিঠ। চির্হি হাসি, জ্যোৎস্নার
জোয়ার ঘরে অকস্মাৎ; চক্রাকার নাচ, ভীত
কবির পায়ের নিচে এখন মাটি; ঘোড়ার কফিন ভক্ষণ।কোথাকার ঘোড়া তুই? এ কেমন রুচি তোর, কফিন চিবিয়ে
খাচ্ছিস? চিৎপটাং চাঁদটাকে করবি কি
সাবাড় শেষ অব্দি? স্তম্ভিত, প্রশ্নাতুর কবিকে
কিছু না ব’লে পাণ্ডুলিপির ভেতর ঘোড়ার প্রবেশ। (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | নিজের নিকট থেকে বহুদূরে চলে যেতে চাই-
দিনের আড়ালে,
রাত্রির ওপরে ভেসে ভেসে যতদূর যাওয়া যায়
ততদূর চলে যেতে চাই। এ শহরে ঘরে কিংবা
বাইরে কোথাও
বলো না থাকতে কেউ আমাকে, এক্ষুণি
আসবাব, বইপত্র, লেখার টেবিল আর কবিতার খাতা
তছনছ করে চলে যেতে চাই অতিদূরে পথরেখা
ধরে একা একা!আমি কি অজ্ঞাতবাসে যাবো সবকিছু ফেলে টেলে?
বন্ধুবান্ধবের মুখ, চিরচেনা আপন গলির মোড়, ভাঙ্গা
বাড়ি, স্বরণের অভ্যন্তরে সারি সারি গাছ,
কিছুই আমাকে ধরে রাখতে পারে না,
পারলেও আমি
নিজের নিকট থেকে দূরে চলে যাবো, তাকাবো না
ফিরে, আমি, বলে দিচ্ছি, চলে যাবোই এখন।বিভ্রম আমাকে কিছুকাল ঘুরিয়েছে পথে পথে,
বুঝতে পারিনি কবে স্বপ্নের মতোন এক মোহন উদ্যান
কাঁটাবন হয়ে গেছে এবং অতিথিবৃন্দ ভোজসভায় হঠাৎ
অজস্র কংকাল হলো, বিকৃত আয়নার
ছবির মতোইদৃশ্যাবলী চতুর্দিকে। চলে যেতে দাও, এরকম দৃশ্য দেখে
ঝিমোতে ঝিমোতে প্রায় উন্মাদের মতো পারবো নাচেচিয়ে উঠতে কোনোদিন মানুষের মধ্যে, আমি
বরং মাটির নিচে নিজেকে আড়াল করে প্রহর কাটাবো।
প্রত্যহ মেঝেতে দেখি শক্ত, মৃত পাখি পড়ে আছে,-
আমি চলে যাবো।
চেতনায় কৃষ্ণপক্ষ নেমে আসে বারংবার বাদুড়ের মতো,
আমি চলে যাবো।
আমার আনন্দ একজন অকস্মাৎ এক ফুঁয়ে
নিভিয়ে দিয়েছে,-
আমি চলে যাবো।
আমার সুখের নৌকো নিমজ্জিত ঘোর কালো গহন নদীতে,
আমি চলে যাবো।
যে পাখি গাইতো গান নিরিবিলি হৃদয়ে আমার
তার বুক একজন তীক্ষ্ণ নখে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলেছে বেবাক,
আমি চলে যাবো।
নিজের নিকট থেকে বহুদূরে চলে যাবো দুঃখিত, একাকী। (প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | শৌখিন আগ্রহে নয়, নয় খেলাচ্ছলে, এসেছিল
আলাভোলা লোকটা এখানে টিনশেডে চুপিসারে
বাঁচাতে নিজস্ব মাথা শিলাবৃষ্টি থেকে। বিপন্ন সে
এসেছিল ভয়ার্ত প্রাণীর মতো বৃষ্টির আঁচড়ে
জব্দ; বাতাসের শব্দ অসংখ্য আহত হায়েনার
ভীষণ গোঙানি যেন। মাঝে মাঝে বাইরে নজর
রেখেছিল লোকটা ঝড়ের রোখ বুঝে নিতে।
নিজেকে অভয় দিতে হয়তো গেয়েছিল গীতএলোমেলো ভাঙা স্বরে খুব সন্তর্পণে। অকস্মাৎ
টিনশেডে এল ছুটে কতিপয় অতিশয় রাগী
লোক, তারপর চোর ভ্রমে আলাভোলা গায়কের
ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জান্তর আক্রোশে। ঝড় জল
থেকে যায়, মিটিয়ে হাতের সুখ ফিরে যায় ওরা;
মৃত্যু তাকে নিয়ে গেল তস্করের মতো আচরণে। (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | শাহেদ বিষণ্ন স্বরে মুখোমুখি বসে-থাকা প্রিয়
সতীশকে বলে, ‘কেন তুমি আজকাল
এরকম কিছু শব্দ ব্যবহার করো যেগুলো কখনও আগে
উচ্চারণ করতে না? আমাদের ব্যবহৃত কিছু
বিশিষ্ট বিদেশী শব্দ মুসলমানেরা
ব্যবহার করে যাতে বাংলার আভাস নেই মোটে!‘শুনতে শুনতে উর্দু শব্দ মুখে অবলীলাক্রমে
চলে আসে। কী করবো, বলো ভাই?’ সতীশ সলজ্জ
কণ্ঠস্বরে বলে ঠোঁটে মৃদু হাসি এনে। শাহেদের
কণ্ঠস্বরে বেদনার রেশ জেগে থাকে। সতীশের
হাতে হাত রেখে বলে শাহেদ, ‘শোনো হে বন্ধু, ছাড়ো
এই রীতি, নিজের বৈশিষ্ট্য থেকে হয়ো না বিচ্যুত কোনও কালে।‘এরপর কেটে গেছে কিছুদিন। শহরে ও গ্রামে
ঘোর, হিংস্র অমাবস্যা নেমে
আসে সংখ্যালঘুদের জীবনে সহসা। কোনও কোনও পুরুষের
প্রাণ ঝরে যায়, যুবতীর মানহানি ঘটে ক্রূর
মনুষ্যরূপের অন্তরালে লুক্কায়িত লোভী পশুর ধর্ষণে।
শাহেদ দেখতে যায় সতীশকে প্রায়শই, সাহস জোগায় সবাইকে।
শাহেদের আরচণ আর আশাবাদী কথামালা
জাগায় সাহস সতীশের ভাবনায়। উপরন্তু নিজেও সে
এই দেশ যা তার আপন জন্মভূমি, এর সোঁদা
মাটি ছেড়ে যাবে না কোথাও কোনও দিন
ডেরা বেঁধে নেয়ার প্রফুল্ল বাসনায়। সতীশের
কথামালা থেকে ইদানিং উর্দু, ফার্সি শব্দাবলী ঝরে গেছে। (গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | স্বদেশমূলক | যখন প্রথম দেখি সেই স্বল্পভাষী, প্রায়
নিঝুম, নিঃশব্দ, কিছুতেই
বুঝিনি অন্তরে তার উদ্দাম, বিদ্রোহী
যুবক লুকানো ছিল। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই-
বয়সে আমার চেয়ে বেশ ছোট হওয়া
সত্ত্বেও ক্রমশ কোনও কোনও ক্ষেত্রে
তাকে আমি শ্রেয় বলে মেনে নিই, যদিও সে হেসে
আমার শ্রেয়তা মেনে নিত
তার পরিচিতদের সকলের কাছে।মনে পড়ে, বহুদিন আগে সেই যুবা,
শাহাদত চৌধুরী এবং তাঁর এক
জ্বলজ্বলে বিদ্রোহী বান্ধব সন্ধ্যাবেলা
হলেন হাজির এক বিদ্রোহী কাজের মতলব
নিয়ে আর সেই সঙ্গে তাদের কথায় ফুটে ওঠে
অপরূপ ফুলঝুরি। মুগ্ধ হয়ে শুনি আগামীর নবীন দলিল।শাহাদত চৌধুরী নিজের অন্তরের জ্বলন্ত আগুন
প্রিয় মাতৃভূমির কল্যাণে করেছেন
অর্পণ সর্বদা হাসিমুখে। তাঁর দেশপ্রেমের স্বাক্ষর
আমার স্মৃতিকে চিরদিন করতে উজ্জ্বল,
যেমন বিশিষ্ট হাসি তার ভেসে থাকে, যখন কাজের
শেষে চেয়ারের গদি ছেড়ে যেতেন একদা। (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | জো, তুমি আমাকে চিনবে না। আমি তোমারই মতো
একজন কালো মানুষ গলার সবচেয়ে
উঁচু পর্দায় গাইছি সেতুবন্ধের গান, যে গানে
তোমার দিলখোলা সুরও লাগছে।
জো, যখন ওরা তোমার চামড়ায় জ্বালা-ধরানো
সপাং সপাং চাবুক মারে আর
হো হো করে হেসে ওঠে,
যখন ওরা বুটজুতোমোড়া পায়ে মারে তোমাকে,
তখন ধূলায় মুখ থুবড়ে পড়ে মানবতা।
জো, যখন ওরা তোমাকে
হাত পা বেঁধে নির্জন রাস্তায় গার্বেজ ক্যানের পাশে
ফেলে রাখে, তখন ক্ষ্যাপাটে অন্ধকারে
ভবিষ্যৎ কাতরাতে থাকে
গা' ঝাড়া দিয়ে ওঠার জন্যে।
যদিও আমি তোমাকে কখনো দেখিনি জো,
তবু বাইবেলের কালো অক্ষরের মতো তোমার দুফোঁটা চোখ
তোমার বেদনার্ত মুখ বারংবার
ভেসে ওঠে আমার হৃদয়ে, তোমার বেদনা
এশিয়া, আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকায় ব্যাপ্ত, জো। |
শামসুর রাহমান | সনেট | নাড়েন সবল হাত ছুটে আসে নফরের দল
তড়িঘড়ি চতুঃসীমা থেকে। তাঁর প্রবল নির্দেশে
সমুদ্রে জাহাজ ভাসে, অবিরাম চাকা ঘোরে কল-
কারখানায়, তৈরি হয় সেতু দিকে দিকে; দেশে দেশে
নিমেষে জমান পাড়ি রাষ্ট্রদুতগণ, কারাগারে
জমে ভিড়, সৈন্য বাড়ে রাতারাতি, কানায় কানায়
ভ’রে ওঠে অস্ত্রাগার, এমন কি আগাড়ে ভাগাড়ে
শকুনের বসে ভোজ। কিন্তু ছোট কোমল ডানায়।ভর ক’রে পাখি আসে ডালে তাঁর নির্দেশ ছাড়াই-
বিখ্যাত কোকিল। ডাকে অন্তরালে, নির্ভীক স্বাধীন।
হঠাৎ বলেন তিনি, ‘পাখিটাকে কী ক’রে তাড়াই?
থামা তোর গান, নইলে দেবো শাস্তি ওরে অর্বাচীন।
তবু সুর আসে ভেসে। কোকিল নয়কো কারো দাস,
কখনো পারে না তাকে স্তব্ধ করতে কোনো সর্বনাশ। (আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | সন্ধ্যে হলেই লোকটা দাতা
হাতেম তাই। তখন তার মুখ থেকে লাগাতার
মণিরত্ন ঝরে, আবার যাতা
শব্দ বেরুতে থাকে, যা নিমেষে নর্দমার
প্রতিযোগী করে তোলে ওর
কণ্ঠনালীকে। লোকটা পকেট উজাড় ক’রে
মধ্যরাতে রিকশায় পায়ের ওপর
পা তুলে ফিরে আসে নিজস্ব গলির মোড়ে।মেঘের ভেতর দিয়ে সে হেঁটে যায়
একা-একা, ভাড়াটে বাড়িটাকে ওর মনে হয়
বাদশাহী আমলের আলিশান মহল, তার দোরগোড়ায়
রাতের রোগাটে কালোয়
দাঁড়ানো এক সপ্রতিভ উট।
ওর গলার ঘুণ্টি সাপের মাথার মণির মতো
জ্বলজ্বলে আর কার্নিশে এলিয়ে-থাকা অন্ধ জলপরীর মুখে চুরুট
অবিরত
জ্বলে আর নেভে। দরবারী ওস্তাদের গান
অমর্ত্য ফোয়ারা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে
সমস্ত চরাচরে
এবং লোকটা নিজেকে ঠাউরে নেয় শের আফগান।
দিনে যেমন তেমন, সন্ধ্যে হলেই কী এক যাদুকাঠির হেলনে
লোকটা কেমন যেন একটু অন্য রকম
হয়ে যায়। ক্ষণে ক্ষণে
তার রূপ পাল্টাতে থাকে। কখনো সে বাক বাকুম
পায়রা, কখনো বা পাথর। গোলাপী ছিটে-লাগা চোখ দুটো
জড়িয়ে আসে
ঘুমে, আবার কখনো কিসের আভাসে
জ্বলে ওঠে ধ্বক ক’রে। লোকটার বুকের মধ্যে একটা ফুটো
আছে যার উৎস থেকে ক্রমাগত
চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে রক্তের মতো
একটা কিছু। অবশ্য এজন্য সে কোনো
শোক পালন করে না কখনো।
আরো অনেক কিছুর মতোই এটাও দিব্যি তুড়ি মেরে
হেসে উড়িয়ে দেয় সে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোথায়
কী গণ্ডগোল পাকাচ্ছে, কোন চলে কখন কে হেরে
যাচ্ছে, কে-ইবা জিতছে; কার দায়
কে বইছে সিসিফসের বোঝার মতো তা নিয়ে
তিলার্ধ মাথা ব্যথা নেই তার।
অথবা জিহ্বা শানিয়ে
মেতে ওঠা তুমুল তর্কে, ঝাঁপিয়ে পড়া শানদার
ভালুকের লড়াইয়ে তা-ও ধাতে
নেই ওর। অবশ্য বেলা অবেলায়
কী এক জুয়োখেলায়
সেঁটে থাকে অথচ তুরূপের তাস রাখেনা হাতে।দিনে দিনে রহিম করিম থেকে
আলাদা হয়ে যাচ্ছে, রাম আর শ্যামের ভেতরকার
সাঁকো গুঁড়িয়ে গেছে; একটা কর্কশ অন্ধকার
অনবরত ঢেকে
ফেলছে সবাইকে, রাম-শ্যাম-যদু-মধু রহিম-করিম
প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাছ থেকে কেবলি শত শত
ক্রোশ বিচ্ছিন্ন হয়ে চলেছে নিঃসীম
সমুদ্রের ধমক খাওয়া নৌকার মতো-
এ ভাবনার প্ররোচনাতার মধ্যে করেনা কোনো বিস্ফোরণের সূচনা।যেই শহরে সন্ধ্যা আসে ব্যেপে
অমনি লোকটা
চোখটা
এদিকে ওদিকে ঘুরিয়ে ওঠে মোহন ক্ষেপে।
তখন ডাল-ভাত আর মুড়ি শশা আর চা-বিস্কুটের স্বাদ থেকে দূরে
স’রে এসে ডোবে ভিন্ন স্বাদে,
এবং ষড়জে নিখাদে
অস্তিত্ব তার অলৌকিক সুরে
গেয়ে ওঠে গান
আর নিমেষে হয়ে যায় সে হাতেম তাই কিংবা শের আফগান। |
শামসুর রাহমান | রূপক | বেজায় ঝাঁকুনি দিয়ে আচানক কেমন
আজব ক’টি কণ্ঠস্বর আমার
নৈশ ঘুম ভাঙিয়ে দিলো। ডানে বামে তাকিয়ে
দেখি ঘরের কোথাও কেউ নেই। শুধু নিস্তব্ধ
থমথমে আঁধার যেন কালো দৃষ্টি ছড়িয়ে
আমার সত্তায় হয়তো কিছু বলতে চায়।
কী কথা অন্ধকারের চোখে? তার চিন্তায়? খানিক
পরেই দেয়ালে ঝুলতে দেখি
জনৈক সুন্দরীর মুখ। বিস্ময় অস্তমিত
না হতেই রূপসীর কণ্ঠস্বর ভ্যাবাচ্যাকা-খাওয়া আমাকে
জড়িয়ে ধরে উচ্চারণ করে, ‘হায় কবি, সাতটি
বসন্ত কাটতেই আমাকে বিস্মৃতির ধুলোয় ছুড়ে দিলে?স্তম্ভিত বাক্যহারা আমি কিছু বলার চেষ্টা
করতে না করতেই সুন্দরী হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো
অজানা কোথায়। ঘরের আলো
জ্বালাবো কি জ্বালাবো না ভাবতে না ভাবতে
কতিপয় অদৃশ্য নারী পুরুষের মিলিত হাসি সুরের
সৃষ্টি করে আমার সত্তায় ঘুমের আমেজ
ছড়িয়ে দিলো। আমি অজান্তেই আলিঙ্গনে বাঁধতে
চাইলাম যেন কাকে। শূন্যতাকে? আমাকে জড়িয়ে ধরে হাওয়া। |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | বড় রাস্তা, ঘুপচি গলি, ঘিঞ্জি বস্তি, ভদ্রপাড়া আর
ফলের বাজার ঘুরে খেলনার দোকানের সামনে
দাঁড়ালাম। কাচের আড়ালে দেখি কাঠের পুতুল,
রেলগাড়ি, ছক-কাটা বাড়ি, আরবি ঘোড়া এক জোড়া,
উড়ন্ত পাখির মতো এরোপ্লেন, টিনের সেপাই।
ভালুক বাজায় ব্যান্ড, বাঁকা-শিং হরিণের পাশে
বাঘের অঙ্গার জ্বলে, বিকট হা করে আছে সিংহ
সারি সারি রয়েছে সাজানো ওহো হরেক রকম
বাজনা বাঁশি বাদশা বেগম আর উজির নাজির।আমার পিরান নেই, পাগড়ি নেই লালমুখো সেই
উজিরের ম’তো, নাগরা নেই পায়। এখন দুপুরে
লেপ্টে আছে পৃথিবীর গায়। কয়েকটি যুবককে
ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওরা-লোকে বলে রাত্রিদিন তারা
নেহাই হাতুড়ি দিয়ে ইচ্ছেমতো চেয়েছে গড়তে
কত কিছু, দেশকে নতুন করে গড়ে পিটে নিতে
চেয়েছে হুজ্জত সব জ্বলন্ত জোয়ান। বুঝি তাই
ঢিট করে দেবে ওরা যৌবনের গোঁয়ার ইচ্ছাকে।“গান বন্ধ কর্ তোরা, নর্তকী নাচের মুদ্রা ভোল”-
“এমন হুকুমনামা জারী হলে সংস্কৃতি সদনে
আমরা গোল্লায় যাব এবং দাঁতাল বর্বরতা
সদর্পে তুলবে মাথা প্রাগৈতিহাসিক কূপ থেকে”
হেঁটে যেতে যেতে বলব কয়েকটি সুবেশ যুবক।
ইচ্ছে হয় মুখ ঘষি খেলনার দোকানের কাচে
বড় ইচ্ছে হয় ঘষি দুটি চোখ। যে-বিড়িটা কানে
গুঁজে ভোরে বেরিয়ে পড়েছি পথে তাই টানি সুখে
এখানে দাঁড়িয়ে ঠায় দুপুরের ঠাঠা রোদে। যদি
ছুঁয়ে দেখি স্বচ্ছ কাচ সূর্যসেঁকা আত্মায় আরাম
পাবো কিছু মনে হয়; দেখি মেঘেরা পালায় দৌড়ে
যেমন ছেলের দল ছুটে যায় পাঠশালা ছুটি
হয়ে গেলে। এ দুপুরে নিজের ছায়াকে দেখে কাচে
ঘুরে-ফিরে কেন শুধু গাঁয়ের নদীকে মনে পড়ে?গাঁয়ের নদীর তীরে একজন বাউল আমাকে
একদিন ‘এদেশে আলোর কথা ভুলে থাকে লোক;
বড় বেশি অন্ধকার ঘাঁটে আর নখের আঁচড়ে
গোলাপ-কলিজা ছেঁড়ে পরস্পর’-বলেছিল হেসে।
নৌকোর গলুইয়ে বসে বুঝিনি সেদিন তার কথা,
আমি শুধু মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলাম তাকিয়ে
তার দুটি উদাস চোখের দিকে; শুনতে পেলাম
নদীর শব্দের সাথে মিশে গেছে বাউলের স্বর।ডেপুটি হাকিম নই, নই কোনো ভবঘুরে কবি;
পথের গোলাম আমি, বুঝেছ হে, অলীক হুকুমে
চৈত্ররাতে ফুটপাতে শুই। ঠ্যাং দুটি একতারা
হয়ে বাজে তারাপুঞ্জে, মর্মরিত স্বপ্নের মহলে
বাউলের কথামৃত স্বপ্নে হয় আমের বউল।‘দ্যাখো দ্যাখো হাড্ডিসার লোকটার মুখের কী ছিরি,
কেতমন বিচ্ছিরি লাগে, দ্যাখো কত নোংরা’ বলে দুটি
তরুণী কলের পুতুলের মতো হেঁটে গেল চলে।
উঁচু বুক দেখে ভাবি পেশোয়ারি উজ্জ্বল দোকানে
দূর থেকে দেখছি তাজ্জব হয়ে টসটসে ফল।
নিজেকে কুচ্ছিত ভেবে লজ্জা পেলে সদর রাস্তায়
আমাদের চলে? উপরে আকাশ জ্বলে নির্বিকার।
যে ভদ্দরলোক এ মুহূর্তে এক খিলি পান কিনে
পুরল শৌখিন মুখে সে অশ্লীল গল্পের নায়ক
হতে পারে সহজেই। হতে পারে বেশ্যার দালাল।
বেইমান দুনিয়ায় খুনসুটি, ভালবাসাবাসি
বুঝি না কিছুই-নাকি বিলকুল বুড় হাবড়া আমি
হয়ে গেছি এতদিনে। কী যে ভাবি এত হাবিজাবি!আমার জীবন নয় সুখের পানসি ঢেউয়ে ঢেউয়ে
ভেসে যাবে অথবা নেইকো’ কোনো তালুক মুলুক
দু’হাতে ওড়াব ব’সে। পুণ্যলোভী দাতার দয়ায়
জীবনে সম্বল শুধু কয়েকটি তামার পয়সা।
গতকাল ফ্রকপরা যে-মেয়েটি একটি দু’আনি
হাসিমুখে দিয়েছিল এই হতচ্ছাড়া ভিখিরিকে,
কাচের আড়ালে রাখা ফুটফুটে পুতুলের মুখে
হঠাৎ পেলাম খুঁজে রাঙা তার মুখের আদল
-আমার মাবুদ তাকে খোশহাল বেগম করুন।যে লোকটা সারাদিন পাখি বেচে গড়েছে সংসার,
হলুদ পাখির মতো যার বউ, সে কেন গলায়
পরে ফাঁস? সে লাশ পচার আগে মৃত এক পাখি
বউটিকে নিশীথে কাঁদাতে এসে দ্যাখে, হা কপাল,
আনন্দে উচ্ছল নারী হয়েছে উৎসব দ্বিধাহীন,
আয়নায় কাজল পরা দুটি চোখ ক্ষুধায় উজ্জ্বল।
‘দূর হ এখান থেকে হা-ভাতে ভিখিরি কোথাকার
আঁস্তাকুড়ে বেছেন আস্তানা, নোংরা খুঁটে খা-গে’-
দোকানি খেঁকিয়ে ওঠে। খেলনা ফেলনা নয় জানি,
এখন এখান থেকে, আল্লা, যাব কোন জাহান্নামে!
খেলনা ফেলনা নয়। ফলের বাজার, পুতুলের
স্থির চোখ…পীরের মাজার হৈচৈ মানুষের ভিড়,গাঁয়ের নদীর তীর গুঞ্জরিত বাউলের স্বরে…
গেরস্তপাড়ায় বেশ্যাবৃত্তি, ভালুক বাজায় ব্যান্ড,
খেলনা ফেলনা নয়… বাজনা বাজে, ফলের বাজার,
ফ্রকপরা ফুটফুটে মেয়েটির একটি দু’আনি
হাতের চেটোয় নাচে, কাচের আড়ালে দুই যোদ্ধা,
সেপাই রাঙায় চোখ, ভদ্দপাড়ায় বাজনা বাজে,
“আস্তাকুড়ে বেছে নে আস্তানা’, খেলনা ফেলনা নয় … (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | অনেকগুলো ছোট ছেলেমেয়ে জুল জুল তাকিয়ে আছে
ফলহীন ফলের গাছের দিকে
ইচ্ছে হয় এক লহমায় প্রতিটি ডালে
বসিয়ে দিই রাঙা টস টসে ফল
প্রতিবেশীনী তরুণীর বয়েস উদাস প্রান্তরে
ছুটছে শাহাজাদার ঘোড়ার মতো
জ্যোৎস্না ওর তৃষ্ণাতুর ঠোঁটে নিরপেক্ষ চুমু খায়
চাঁদ ওকে স্বপু দেখায়
দুধরঙ সরোবরকে কাটছে ছুরি
যে ওর যৌবনে অবগাহন ক’রে হবে
মোরগ ফুলের মৃর্তি
তাকেই খুঁজছি অষ্টপ্রহর
অলৌকিক সূর্যমুখীর স্বপ্নে বিভোর এক যুবা
হাতে চিবুক ঠেকিয়ে
বসে আছে ডালিম গাছের তলায়
বার বার তার হৃদয়ের সূর্য হয়ে যাচ্ছে কালো
আর পূথিপত্র থেকে আহরিত চিন্তার ভারে
সে ভীষণ কৃশকায় প্রায় মুমুর্ষু
এক্ষুণি ওর অঙ্গ প্রত্যঙ্গে অনেকগুলো
সূর্যমুখী ফুটিয়ে দিলে হতাম ঝর্ণাধারা
কী-যে হয় আমার বিকলাঙ্গ হিরোশিরা
আমাকে কেবলই দিচ্ছে ঠেলে
দেয়ালের দিকে আমার উপরে ধাবমান ট্রেন
ঠাসঠাসি শবের মধ্যে নির্কণ্ঠ হাহাকার
জীবন্মৃত আমি সুন্দরতম উদ্যানের কাছে
পৌঁছতে গিয়ে ঢুকে পড়ি শ্বাসরোধকারী অস্ত্রাগারে
যদি বিশ্বের যাবতীয় অস্ত্রাগার
আমার ইচ্ছে দোলায়
হতো ঝকঝকে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর
অথবা শস্যভান্ডার
তাহলে আমাকে ঘিরে তারাবাতির ফোয়ারা
প্রেমের কবিতার ষ্ফুরণ শ্যামা পাখির গান (খন্ডিত গৌরব কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | প্রেমমূলক | তোমার আমার মধ্যে ক্রমাগত রচিত হচ্ছে মাইল মাইলব্যাপী
তৃষ্ণার্ত জিহ্বার মতো গা ছমছম প্রান্তর। অদূরে
অনেক ক্ষুধার্ত শকুন
অপেক্ষমাণ, আর আমি ওদের দৃষ্টি থেকে,
শবগন্ধী চঞ্চু থেকে নিজেকে আড়াল করে হাঁটছি
ভারি পা টেনে টেনে।
কোথাও এমন কোনো পাখি নেই,
যার গানে দিকগুলি মাধুর্যের আভায় হবে রঙিন,
নেই কোনো ঝরনা, যার ছলছলে হাসি
আমার ক্লান্ত তৃষ্ণার অন্ধকারকে
মুছে ফেলবে নিমেষে।
এখন আমি তোমার দিকে মুখ রেখে এই বেয়াড়া প্রান্তর
পেরুনোর জন্যে বিশ্রামের কোটর
তছনছ করে ফেলেছি,
আমার স্বস্তি ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়েছে এক দূরন্ত ঈগল,
তার ডানার ঝাপটা আমার নিত্যসঙ্গী।
আমি কী করে না দেখে থাকব সেই তোমাকে
যার মধ্যে মেদুর অপরাহ্নে
অলৌকিককে গ্রীবা বাড়াতে দেখেছি,
যার মধ্যে শুনেছি সুন্দর ভবিষ্যতের নিঃশ্বাস,
যার কণ্ঠে শুনেছি মৃত্যু-ভোলানো উচ্চারণ?’
আমি কী করে না দেখে থাকব সেই তোমাকে,
যার চোখ আমার প্রৌঢ়ত্বের অন্তরালে ধ্রুবতারা;
যার ওষ্ঠে সেই নদীর গান শুনি, যাকে আমি
দেখেছিলাম
অনেক আগে, সূর্যোদয় পেরিয়ে
গাছগাছালির ঘ্রাণ নিতে নিতে,
যার বুকের দ্যুতি কখনো আমাকে অন্ধ করে,
কখনোবা চক্ষুষ্মান, যার শরীরের প্রতিটি বাঁকে
সদ্য যুবার মতো মুখ রাখে আমার বাসনা?
এখন আমি আমার একাকিত্বের প্রবাসে
তলোয়ার মাছের মতো
নিয়ত সন্ধানী আর উদাস-নিষ্ঠুর।মনে পড়ে
ঈষৎ উজ্জ্বল লাল বারান্দায় তুমি দাঁড়ানো-
আমি দেখছি তোমাকে, যেমন বয়স্ক বাজপাখি
চোখ তুলে চাঁদ। তুমি সেই মুহূর্তগুলিকে সাজালে
বিদেশী কবিতার পঙ্ক্তিমালায়;
সেই শব্দগুচ্ছে ছিল না কোনো বিদায়ী শ্লোকের বিচ্ছুরণ,
অথচ আমি বিচ্ছেদকে ডানা মেলতে দেখলাম
ঈষৎ উজ্জ্বল দীর্ঘ বারান্দায়
আমার অস্তিত্বে তোমার হাতের অন্তরঙ্গ তাপ সঞ্চয় করে
দৃষ্টিতে তুমিময় ছবি গেঁথে,
পথ চলি, ভালোবাসায় দেখি সত্যের মুখ।দূর থেকে আমি হাত নাড়ি, তোমার স্মৃতির ভোরে বিভোর
এখন তোমার সান্নিধ্য থেকে নির্বাসিত আমি আর
অন্ধকার কুকুরের মতো
লেহন করছে আমাকে। মাঝে-মধ্যে এই রাত্রি
জন্মান্ধ গায়কের সুরে বেজে ওঠে
আমার শিরায় শিরায়, আশ্চর্য এক ফোয়ারা
আমার ভেতরে তরলিত মণিরত্ন ছড়াতে থাকে,
এবং তোমার অনেকানেক আসা-যাওয়া
স্মৃতির ঝোপঝাড়ে জোনাকি।
‘কখনো নয়, বিলুপ্তি, মনে-না-পড়া, ফিরব না’
ঝরে আমার চোখের পাতায়, স্বপ্নে তোমার শরীর
লতাগুল্মময়, পাতালে ভাসে,
আমাকে ছোঁয় তোমার কণ্ঠস্বর,
আমার সমগ্র সত্তা শ্লোক হয়ে জড়িয়ে যায়
তোমার কণ্ঠস্বরে, আমার হৃদয়
মরীচিকার মতো কাঁপে শূন্যতায়, রুক্ষ শূন্যতায়। (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | জনহীন শিল্পশালায় ভজেছি শূন্যতাকে।
ললাটে অভিশাপের নিদারুণ জড় ল বয়ে
চলেছি নিরুদ্দেশে অজানা জলের ডাকে।
প্লাবনের দামাল হাওয়া বয়ে যায় সত্তা জুড়ে।স্মৃতিতে উদ্ভিদেরই মায়াবী পুরান ছায়া,
সাগরে যাচ্ছি ভেসে বুড়োটে ভেলায় চেপে।
কবে যে পালের ফালি নিমেষে উধাও হলো,
জানি না হঠাৎ কবে ছিঁড়েছে দাঁড়ের দড়ি।অজানা সমুদ্দুরে কুহকী নারীর গানে
হারালো দিক্-নিশানা; শোণিতের রুদ্র ঝড়ে
মায়াবী পাহাড় ছুঁয়ে নিমেষে মজলো যারা,
তাদেরই হাড় ক’খানা জমেছে পাথর ঘেঁষে।কে ঘোড়া মেঘের সাঁকো পেরিয়ে স্বপ্নে আসে?
বুঝি তার খুরের ঘায়ে নীলিমা হচ্ছে গুঁড়ো।
কে জাগায় তন্দ্রা তটে? বেঘোরে বৈঠা দেখি
অবেলায় শিথিল মুঠোয় সহসা উঠলো নড়ে।নিয়ত লবণকণা ক্ষতকে কামড়ে ধরে।
কখনো ঢেউকে ভেবে রমণীর বক্ষচূড়া
মনে হয় ঝাঁপিয়ে পড়ি নিরালা অতল জলে!
কখনো জলজ প্রাণী চকিতে মুখটি তোলে।সবুজের আশায় জ্বলে একাকী পায়রাটাকে
ছেড়েছি মুঠোয় থেকে ধু-ধু সেই নীলাম্বরে।
নিয়ে তার তীক্ষ্ণ ঠোঁটে সুদূরের চিকন পাতা
ফেরেনি ভেলায় আজো, ফেরেনি পায়রা শাদা।কিমিয়ার গোপন মায়া এখনো রক্তে নামে।
পুরানের ভগ্ন ছায়ায় বেদনায় পুতুল গড়ে
চলেছি নড়বড়ে এক বুড়োটে ভেলায় চেপে-
অবেলায় যাচ্ছি ভেসে, কেবলি যাচ্ছি ভেসে। (বিধ্বস্ত নিলীমা কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | শান্তি কি হরিণ হয়ে ঘুমাচ্ছিল এখানে কোথাও? ‘স্বপ্ন দাও’
বলে সে কি ঘুমের ভেতর অন্তরীণ
উঠেছিল নড়ে? তার শরীরে আঁচড়
পড়ে এলোমেলো, জেগে বিখ্যাত দু’চোখ
মেলে খোঁজে ঝিলের ঝলক ত্রস্ত তাকায় অদূরে,
দেখে নিতে চায় সন্ত্রাসের নেশায় মাতাল কোনো
ব্যাধের নিশানা তীক্ষ্ণ হয়ে আছে কি না।
অথচ বাজায় বীণা গাছ, প্রজাপতিদের নাচ
পাতায় পাতায়; তবু ভয় জেগে রয়
স্পন্দিত হৃদয় জুড়ে। কত ভালো হয়, যদি গুপ্ত
নিষাদের পায়ের তলার মাটি দ্রুত সরে যায়,
দেবতার হাত নেমে আসে অকস্মাৎ মেঘ থেকে। (আকাশ আসবে নেমে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | লোকটার নেই কোন নামডাক।
তবু তার কথা অষ্টপ্রহর
ভেবে লোকজন অবাক বেবাক।লোকটার নেই কোনোখানে ঠাঁই।
জীবন লগ্ন পথের ধুলায়,
হাতে ঘোরে তার অলীক লাটাই।লোকটা কারুর সাতে-পাঁচে নেই।
গাঁয়ের মোড়ল, মিলের মালিক-
তবু ঘুম নেই কারুর চোখেই;
লোকটার কাঁধে অচিন শালিক।
বলে দশজনে এবং আমিও
রোদ্দুর খায় লোকটা চিবিয়ে,
জ্যোৎস্নাও তার সাধের পানীয়।
হাজার প্রদীপ জ্বালায় আবার
মনের খেয়ালে দেয় তা নিবিয়ে।মেঘের কামিজ শরীরে চাপিয়ে
হাঁটে, এসে বসে ভদ্রপাড়ায়।
পাথুরে গুহায় পড়ে না হাঁপিয়ে
সে-ও সাড়া দেয় কড়ার নাড়ায়।
তবু দশজনে জানায় নালিশ
লোকটা ঘুমায় সারাদিনমান,
কাছে টেনে নিয়ে চাঁদের বালিশ। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | মানবতাবাদী | কে যেন আমাকে ডাকে আবছা দূরত্ব থেকে আজ,
চেনা কি অচেনা সেই আর্ত কণ্ঠস্বর
বোঝা দায়, সে কি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে?
নাকি তার অন্তর্গত বেদনা ভোগাচ্ছে বড় বেশি?
অস্থিরতা আমাকে দখল করে নেয়
মোহাবিষ্ট চেয়ে থাকি দিগন্তের দিকে।কোথায় দিগন্ত এই আকাশকে চুমো-খাওয়া সব
উচ্চাকাঙ্ক্ষী দালানের ভিড়ে? হা, কপাল,
কী ক’রে অসুস্থ দৃষ্টি দিয়ে ছোঁব
হারানো দিগন্ত-রেখা, কে আমাকে বলে দেবে আজ?
কোথাও যাওয়ার মন নেই এই গুমোট প্রহরে, বসে আছি
অন্ধকার ঘরে একা। কাকে খুঁজে বেড়াব এখন
কোন পথে? কোন আস্তানায় গেলে পেয়ে যাব ঠিক
মনের মানুষ এই প্যাঁচা-ডাকা পরিবেশে? প্রবীণ আঁধারে
হঠাৎ উদিত হল চাঁদ,
ঠোকরে ঠোকরে তাকে কাচের পাত্রের মত গুঁড়ো
করে ফেলে হিংসুটে দানব এক, মৃত্যুগন্ধী অন্ধকার নেমে
আসে যেন ত্রিভুবনে। মানবিক হাহাকারে ডোবে সবদিক।যে কাব্য রচনা ক’রে পাণ্ডুলিপি তার
লুকিয়ে রেখেছিলাম তাণ্ডবের কালে
ভূতলে একদা, হায়, হয়েছে তা’ কীটের ডিনার।
বস্তুত নিজেরই সৃষ্টি আজ স্মরণের অন্ধকার
কুঠুরির কালো ধুলোকণা।এ কেমন কৃষ্ণপক্ষ করেছে ঘেরাও আমাদের
ইদানীং? কেউ কাউকেই আর পাচ্ছে না দেখতে,
ঘুরছি বিপথে শুধু নিঃসঙ্গ, অসুস্থ অস্তিত্বের
ভার বয়ে; যতদূর দৃষ্টি যায়, মানবের চিহ্ন নেই কোনও,
উপরন্তু এখানে সেখানে ফাঁদ পাতা আছে-
এই তথ্য জেনেও ফায়দা নেই, আজ
আমাকে যেতেই হবে বেলাবেলি যতটা এগিয়ে যাওয়া চলে।এখনও কখনও পুরনো শ্যাওলায় বন্দী হয় মানবতা,
কখনও বা বেনোজলে ক্রমাগত ভেসে যেতে থাকে। (ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছেকাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | একটি দশক ছিল প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো,
কিছু বা কাটায় কীর্ণ, সেয়ানা কীটের
লোভ ছিল জেগে
সাপের মণির মতো, গণিকার প্রসাধন-চটা
বিশীর্ণ মুখের মতো ছিল রোগ শোক,
বিলাপে পড়েনি ভাটা, যদিও আনন্দ ধ্বনি প্রাণে
বুনেছে সৌন্দর্য, খৃষ্টপূর্ব শতকের
গোধুলি এসেছে নেমে সোনালি কুয়াশা হয়ে আর
হরিণের ছালে
ডোরাকাটা বাঘের মুখের লালা ঝরেছে নিয়ত।একটি দশক আমি তার কথা জানতে পারিনি।
সে-কথা লুকোনো ছিল রোদপেড়ো পাতার আড়ালে,
লতাগুল্মে, পর্যটক মেঘে
দরবারী কানাড়ার পরতে পরতে,
সূর্যাস্তের অবসন্ন বিশদ মোটিফে,
ঈগল এবং রাগী সাপের বিবাদে।একটি দশক আমি তার কথা জানতে পারিনি,
অথচ ছিল সে আশপাশে
বিকশিত রাগিনীর মতো। অকস্মাৎ
একটি গভীর রাত চন্দ্রমল্লিকার
সৌরভ বিলায় পোড়-খাওয়া অস্তিত্বের
অলিতে গলিতে,
নৈশ ঘ্রাণে ভরপুর স্বরের চুমোয়
প্লাস্টারের মতো খসে পড়ে দীর্ঘ দশটি বছর।
বয়সে গোলাপ ফোটে, সহসা যযাতি
পুরুরবা হয়ে যায়, ধাবমান পাঁচটি ঘোড়ার
ঘাম আর মুখের কবোষ্ণ ফেনা ঝরে
শিরায় শিরায়,
আমার প্রতিটি রোমকূপ
নিমেষেই ময়ূরের চোখ হয়। এক দশকের
দ্বিধা আর সংশয়ের সূর্যাস্তের পরে
বস্তুত সত্তার মৌন তটে
অপরূপ সখ্যে জেগে ওঠে দুলিয়ে চিত্রিত মাথা
মনসার গৌরবের মতো এক অনার্য সভ্যতা। (অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | প্রত্যহ চৌদিকে দেখি চর্মচোখে অনেক কিছুই-
ছায়াচ্ছন্ন নিরিবিলি গলির ভেতরে সারি সারি
ছোট গাছ, মৃত চিল, প্লাস্টিক চিরুনি; নীল শাড়ি
বারান্দাকে চুমো খায়। মৃৎপাত্রে একরাশ জুঁই।
টেবিলে কলম একা পোহায় বিশ্রাম, আস্তে ছুঁই
তাকে, বই স্বপ্ন দ্যাখে, দেয়ালে প্রাচীন তরবারি,
রুক্ষ গোরখোদকের কোদাল, মালীর ফুলঝারি-
বস্তুময় সব জায়গা, দেশ কিংবা বিদেশ বিভূঁই।শুধু কি বস্তুর বহিরঙ্গ দেখে তৃপ্ত হবো আমি?
এখন নিজেকে বলি- বস্তুর নিছক উপস্থিতি
ইসস্তত আশেপাশে আমার গভীর ভালো লাগে,
তবু চাই তশ্তরি, তম্বুরা এক নিবিড় সংরাগে
নতুন বিমূর্ত হোক বর্ণোচ্ছ্বসে আর অস্তগামী
সূর্য, জলপানকারী ঘোড়া হোক ভিন্ন কোনো স্মৃতি। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | করাতের অসংখ্য দাঁতের মতো মুহূর্তগুলো
আমাকে কামড়ে ধরেছিল, আর সেই মরণ-কামড়ে
আমি ঝাঁঝরা শরীরটাকে দু’ একবার নেড়েচেড়ে
পৃথিবীর বন্ধ দরজা নখ দিয়ে আঁচড়াতে আঁচড়াতে
নিঃসাড় হয়ে যেতে পারতাম।
কিন্তু আমার দুঃখ-চর্চিত ললাটে
অন্য সম্মানের আভাস ছিল বলেই
বেঁচে রইলাম। তৃষ্ণার দুপুরে কোনো আহত সাপের মতো
এক সীমাহীন ক্রোধে, মূর্খ যন্ত্রণায় নিজেকে টেনেহেঁচড়ে
বেঁচে রইলাম সর্বনাশের পাশ কাটিয়ে
সমস্ত দুর্দশার মুখের ওপর আমার প্রবল থাবা মেলে দিয়ে।জীবনকে খণ্ড খণ্ড চিত্রে দেখেছি-কখনো সুন্দর
কখনো কুৎসিত। যুবককে দেখেছি
দুপুর সন্ধ্যা আর রাত্রিকে রেণুর মতো
উড়িয়ে দিতে হাওয়ায় আর বৃদ্ধকে দেখেছি তার
খাটো মোমবাতিটাকে হিংসুক বাতাসের
বিরোধিতা থেকে রক্ষা করার জন্য কী ব্যস্তবাগীশ।কখনো অশেষ হঠকারিতায় জীবনকে একটা
আংটির মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে চেয়েছি,-কখনো
সময়ের জরায়ু ছিঁড়ে নিতে চেয়েছি
কয়েকটি টসটসে নিটোল কালো আঙুর,
যাদের আমি ঠোঁটে নিয়ে থেঁতলে দিতে, পিষে ফেলতে
ভালবাসি, ভালবাসি যাদের মাংসল কণাগুলো ছুড়ে ফেলে দিতে
ইতিহাসের হলুদ জঞ্জালে।
পেঁজা তুলোর মতো তুষারে অশ্বেতরের
পায়ের ছাপ, সোনালি গমের মাঠ
আগুনের লকলকে জিভ কিংবা ধোঁয়াটে
সন্ধ্যার প্রান্তরে খণ্ডিত সৈনিক
একেই বলবে কি ইতিহাসের বিশ্বস্ত বিবৃতি?একটি আলোকিত দেহকে বিনাশ করবে বলে যারা
ক্রুশকাঠে পেরেক ঠুকেছিল, তাদের
উৎসব, ব্যভিচার কিংবা যারা বালিতে, অন্ধকার
গুহার দেয়ালে মাছের চিত্র এঁকে
ক্রুশবিদ্ধ অস্তিত্বের মহাপ্রয়াণে চোখ মুছেছিল,
তাদের ঘরকন্না, প্রেমের ব্যাপ্ত বলয়, তা-ও কি
অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয় প্রতারক ইতিহাসের?ইতিহাস সরোদের মতো বেড়ে উঠলে
আমি সুখী, দামামার মতো গর্জে উঠলে
দুঃখ আমাকে বিবর্ণ করে। জীবন যখন বর্বরের মুঠোয়
কপোতের নরম বুকের মতো কেঁপে ওঠে,
গহন পাতালের প্রাগৈতিহাসিক শীতল জল
নিভিয়ে দিতে চায় হৃদয়ের আগুন,
আমার সমস্ত সম্ভ্রম আর উল্লাস
অর্পণ করি আগামীর অঞ্জলিতে
‘কেননা ভবিষ্যৎ এক
জলদমন্দ্র সুর ইতিহাসের ধ্রুপদী আলাপে। (রৌদ্র করোটিতে কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | সনেট | কাল সারারাত আমি কবিতার সঙ্গে অতিশয়
লুত্কা লত্কা করে কাটিয়ে দিয়েছি। বাতি জ্বেলে
দেখেছি উত্তুঙ্গ স্তন, নাভিমূল শ্রোণী; লজ্জা ফেলে
স্খলিত শাড়ির মতো কবিতা আমাকে, মনে হয়,
অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ করে নিয়েছিলো কাল। মন জয়
করতে পেরে তার চতুর্দশপদী আর ভিলানেলে
আনন্দ পেয়েছি ঢের। হৃদয়ের তন্তুজাল ঠেলে
এখনো কবিতা এসে আমাকে করছে ছন্দোময়একটি কি দুটি নয়, বহু কবিতায় আজ ভোরে
আমার পকেট ভর্তি, যেন নিয়ে উৎসবী আবেগ
ঘরের ভেতরে, বারান্দায় আমার হৃদয় নাচে।
এসব কবিতা আমি কণ্ঠস্বরে কিছু রাঙা মেঘ
ঢেলে দিয়ে তোমাকে শোনাতে চাই আজ প্রাণ ভরে
এক্ষুনি সবার আগে, অথচ তুমিই নেই কাছে। (মাতাল ঋত্বিক কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | রূপক | ঢের পথ ঘুরে এক হ্রদের কিনারে এসে বসি
সন্ধেবেলা শারীরিক ক্লান্তি মুছে ফেলে
শান্তির শীতল স্পর্শে ডুবে
যাওয়া খুব সহজেই হবে-
এমন ধারণা খেলা করছিল কিছুক্ষণ থেকে।
ফলত হ্রদের দিকে তাকাই আনন্দে প্রীত জলে।মনে হ’ল, প্রীত জল থেকে মাথা তুলে
তাকাল আমার দিকে অপূর্ব সজল চোখে আর
ইশারায় দিল ডাক। অপরূপ তরুণীর আহ্বান উপেক্ষা
করার ক্ষমতা কোনও মানবের নেই। আমি জলে নেমে
যাওয়ার আগেই দৃশ্য তরুণীবিহীন হয়ে গেল।
বিষাদ আমাকে ছেয়ে ফেলে, তবুও মুক্তির আভা জাগে।
বেশ কিছুক্ষণ পর আসমানে যুবতীর সুডৌল স্তনের
মতো চাঁদ জেগে ওঠে। জ্যোৎস্নাধারা হ্রদ,
পাশের গাছপালা, ঝোপঝড় যেন
বাতাসের স্পর্শে নর্তকীর মতো হয়ে যায় আর আমি
লোভী বালকের মতো তাকাই কাছের
প্রকৃতির দিকে, ভাবি কী মহিমা ছড়ানো চৌদিকে।সমুখে তাকিয়ে ভাবি, আমি কি এখন হ্রদে নেমে
ভাসাব নিজেকে? হয়তোবা আমার প্রকৃতি-প্রেমে কোনও
জলপরী মুগ্ধ হয়ে কাটবে সাঁতার বেপরোয়া
কবির সান্নিধ্যে-হয়তোবা তার মায়া
ক্ষণিকের হলেও বয়েসি লোকটির কতিপয় মুহূর্তকে
রাখবে অক্ষয় ক’রে। দেবে কি কবিকে অমরতা? (অন্ধকার থেকে আলোয় কাব্যগ্রন্থ) |
শামসুর রাহমান | চিন্তামূলক | এ অতি সামান্য কথা, আপনার নিশ্চয় জানেন-
দাঁত ক্ষয়ে গেলে বাঘ হয়ে যায় কিছুটা দুর্বল,
বনের পশুরা তাকে ফাঁকি দিয়ে নাকের তলায়
তার দিব্যি করে আনাগোনা, তাই সে প্রায়শ
মেটাতে দাঁতের সুখ, সুতীব্র জঠরজ্বালা দেয়
হানা শান্ত গেরস্ত পাড়ায়। অবশেষে দশদিকে
তুখোড় মানুষখেকো বলে খ্যাতি রটে তার। যারা
কবিতা লিখতে গিয়ে কাব্যলক্ষ্মীর ছাউনি থেকেনির্বাসিত হয়, তারা যদি বাগিয়ে কলম নিত্য
শজারুর মতো রেগে ঝোপঝাড় তছনছ করে,
রাশি-রাশি পুঁথি ঘেঁটে, তথ্যের টিলায় হাঁটু গেড়ে
সমালোচনায় মাতে, কাব্যমীমাংসার ভার নেয়
নিজ হাতে তুলে, তবে ওরা সোনালি পদবী পায়
একাডেমী থেকে, আর কবি থাকে শত হস্ত দূরে। (হোমারের স্বপ্নময় হাত কাব্যগ্রন্থ) |