content
stringlengths
0
129k
"কোনো সমস্যা স্যার?"
"সবাইকে জড়ো করো
কথা বলা প্রয়োজন
" গম্ভীর স্বরে তিনি বলেন
নিশব্দে বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে এগিয়ে যায় আউয়াল
দীর্ঘদিনের ট্রেনিং তাকে বিড়ালের মত শব্দহীন বানিয়ে ছেড়েছে
অল্পক্ষণের মধ্যেই সবাইকে জড়ো করে ফেলে আউয়াল
দ্রুতগতিতে তাঁর নজর ঘুরে আসে সবার উপর দিয়ে
দৃঢ় প্রত্যয়ী সব মুখ
নির্ভীক চোখ
কিন্তু তারপরেও তাদের অস্থিরতাটুকু দৃষ্টি এড়ায় না তাঁর
অধৈর্য হয়ে পড়েছে এই তরুণেরা
"তোমরা জানো আমরা কেন এসেছি এখানে
ওপারে শত্রুরা অপেক্ষা করছে
ওদের নিকেশ করে চাপাই নবাবগঞ্জের দখল নিতে হবে আমাদের
ভারতীয় বাহিনী আমাদের সাহায্য করার কথা ছিল
কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই সাহায্য আমরা পাই নি
পাবো কিনা তাও জানি না
ওয়ারলেসে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না তাদের সাথে
" সামান্য থামেন তিনি
এক ঝলকে ঘুরে এলেন সবার মুখ
মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনছে সবাই
"সাহায্য আসে নি, খারাপ কথা
কিন্তু এর জন্য আমরা বসে থাকতে পারি না
আমরা মুক্তিযোদ্ধা
দেশকে শত্রুমুক্ত করতে লড়ছি আমরা
এই যুদ্ধ যখন শুরু করেছিলাম, আমরা কারো আশায় শুরু করি নাই
কেউ আমাদের সাহায্য করবে সে আশাও আমরা করি নাই তখন
এটা আমাদের যুদ্ধ, নিজের মাকে বাঁচানোর যুদ্ধ
নিজেদেরই এগিয়ে যেতে হবে আমাদের
আবারো থামেন তিনি
সহযোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ
ঘাড় ঘুরিয়ে একবার মহানন্দার দিকে তাকান
মৃদু একটা কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করেন
তারপর আবার শুরু করেন
"মহানন্দা পার হবো আমরা
তারপর চোরাগুপ্তা আক্রমণ শানাবো শত্রুর উপরে
অনেকটা হাতাহাতি ধরণের
মেশিনগানটাকে অকেজো করতে হবে
এর জন্য বিশজন লোক প্রয়োজন আমার
কে কে যাবা আমার সাথে, হাত উঠাও
একটা হাতও ওঠে না
তার পরিবর্তে পিছন থেকে ভেসে আসে মৃদু কণ্ঠের জিজ্ঞাসা
"এটা কি আত্মঘাতী মিশন?"
স্থির চোখে তিনি তাকিয়ে থাকেন সহযোদ্ধাদের দিকে
চোখ দুটো কুঁচকে গিয়েছে
চোয়ালটা সামান্য শক্ত
"হ্যাঁ, এটা আত্মঘাতী মিশন
আমিসহ তোমাদের এই বিশজনের কেউ-ই হয়তো কাল আর বেঁচে থাকবো না
যদি বেঁচে থাকি, আবার দেখা হবে
নাহলে এই শেষ দেখা
স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা অংশ নেয়, তাদের মধ্যে খুব কম লোকই বাঁচে
আমরা ভাগ্যবান যে এখনো বেঁচে আছি
কিন্তু এই অপারেশনে যাওয়া বা না যাওয়াটা তোমাদের ইচ্ছাধীন
আমি কাউকে জোর করবো না
তাঁকে অবাক করে দিয়ে একে একে সবগুলো হাত উঠে আসে শূন্যে
অজানা আবেগে চোখের কোণ দুটো ভিজে যায় তাঁর
ভাগ্য ভালো আবছা অন্ধকারে কেউ দেখতে পায় নি তাঁর এই আবেগ
নইলে ভারি লজ্জায় পড়ে যেতে হতো তাঁকে
কিংবা কে জানে দেখেছে হয়তো
"এদের মধ্য থেকে বিশজনকে বাছাই করো আউয়াল
আর কয়েকটা নৌকা জোগাড় করো
কাল ভোরে আমরা নদী পার হবো
বাকিদের নিয়ে তুমি এখানে থাকবে
আমরা ইশারা করলেই মহানন্দা পার হবে তোমরা
তার আগে নয়
" আদেশ করেন তিনি
কুয়াশার চাদরকে আড়াল হিসাবে ব্যবহার করে ঠিক ভোরে নদী পার হয়ে আসে যোদ্ধা দলটা
উত্তর দিকের বাংকার থেকে কমান্ডো আক্রমণ শুরু করে তারা
নীরবে, নিঃশব্দে
বাংকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে বেয়োনেটের আঘাতে পরপারে পাঠিয়ে দিতে থাকে পাকিস্তানিদের
আর মাত্র অল্প কিছু বাংকার বাকি
এই সময়েই টের পেয়ে যায় পাকিস্তানিরা
বাধের উপরে কিছু সৈন্য ছিল
তারাও এসে যোগ দেয় এদের সাথে
অনর্গল গুলি ভেসে আসতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে
মেশিনগান থেকে খইয়ের মত গুলি ফোটাচ্ছে পাকিস্তানিরা
হাতাহাতি যুদ্ধ শেষ
গুলির প্রত্যুত্তরে গুলিই চালাতে হবে
ব্যাগের ভিতর থেকে গ্রেনেডটা বের করেন তিনি
ক্রলিং করে এগিয়ে যান মেশিনগান রাখা বাংকারের দিকে
এটাকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত শান্তি নেই তাঁর
বাংকারের খুব কাছে এসে গ্রেনেডের পিন খোলেন তিনি
তারপর ডান হাতটাকে উঁচিয়ে গ্রেনেডটাকে সর্বশক্তি দিয়ে ছুড়ে দেন বাংকারের দিকে
ভয়ংকর বিস্ফোরণে কেঁপে উঠে চারিদিক
গ্রেনেডটা ছুড়েই বুঝেছিলেন যে, এতেই কাজ হবে
প্রবল আত্মতৃপ্তি নিয়ে তিনি তাকিয়ে থাকে আগুনের লেলিহান শিখার দিকে
চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে আগুনের ফুলকি
ফুলকিতো নয়, যেন ফুল ঝরে পড়ছে চারপাশে
পরম তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে তাঁর ঠোঁটে
ক্লান্তি আর অবসাদে ঘুম এসে যাচ্ছে
চোখ মুদলেন তিনি
আহ! কী শান্তি!!
"পালিয়ে গেলো, পালিয়ে গেলো
" বিকট শব্দ আর হৈচৈ এর মধ্যে কে যেনো চেচাচ্ছে
চোখ খুলে এদিক ওদিক তাকালেন তিনি
আগুন আর ধোঁয়ায় একাকার চারিদিক
ডান পাশ থেকে নাদিম নামের বাচ্চা ছেলেটা চেচাচ্ছে
এরই বাবরি চুল জোর করে কেটে দিয়েছিলেন তিনি
নাদিমের প্রসারিত হাত এক পলায়নপর পাকিস্তানি সেনার দিকে