content
stringlengths
0
129k
আফ্রিকার আরেক মহানায়ক কঙ্গোর স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা প্যাট্রিস লুমুম্বাকে হত্যা করেছিল বিশ্বের সকল সাম্রাজ্যবাদ মিলিতভাবে
তারপর সেই দেশে যে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তাতে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন কিউবার আন্তর্জাতিক গেরিলারা
সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন চে গুয়েভারা ও কিউবার আরেক বিপ্লবী নেতা হোসে রিসকেট
এই প্রসঙ্গে আমি একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে চাই
১৯৯০ সালে হাভানায় কমরেড হোসে রিসকেটের সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ হয়েছিল
কথা প্রসঙ্গে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "আপনারা যে আফ্রিকায় সৈন্য পঠাচ্ছেন বিপ্লবীদের সমর্থনে, এটাকে কি বিপ্লবের রফতানি বলা চলে না, যা মার্কসবাদ অনুমোদন করে না?"
উত্তরে তিনি যা বলেছিলেন তা আমাকে অভিভূত করেছিল
তিনি বললেন, "কিউবার জনগণের ৪০ শতাংশ হচ্ছে কৃষ্ণবর্ণের
আপনি কি জানেন, কারা এদের পূর্বপুরুষ? এদের পূর্বপুরুষ ছিলেন আফ্রিকাবাসী, যাদের ইয়াংকি ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ হাতে পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে নিয়ে এসেছিল দাস হিসেবে
আমরা যখন আফ্রিকায় যাই, তখন আমরা বহিরাগত হিসেবে যাই না
আমরা আমাদের আফ্রিকান রক্তের ডাকে সাড়া দিই
যারা একদা আমাদের পূর্বপুরুষদের দাস বানিয়েছিল আমরা সেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই লড়াই করতে যাই
সত্যিই আমি অভিভূত হয়েছিলাম এমন উত্তর শুনে
কিউবার আন্তর্জাতিক যোদ্ধারা এঙ্গোলায় মোকাবিলা করেছিলেন আগ্রাসী দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের ফাসিস্ত বাহিনীকে
১৯৮৭-এর শেষ ভাগে "আফ্রিকার স্তালিন গ্রাড" নামে পরিচিত কুইটো কুয়ানাভালে সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হয়েছিল বর্ণবিদ্বেষী ফাসিস্ত বাহিনী
এই ঘটনা যেমন এঙ্গোলার জনগণের জন্য বিজয় এনেছিল, তেমনই তা নামিবিয়ার স্বাধীনতার পথকে প্রশস্ত করেছিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারকেও দুর্বল করেছিল
মুক্তি লাভের পর দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি হিসেবে নেলসন ম্যান্ডেলার দেখা হয়েছিল কিউবার বিপ্লবের মহান নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে
ম্যান্ডেলা কিউবার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বলেছিলেন, "আমাদের এই মহাদেশে (আফ্রিকা) কিউবানরা এসেছিলেন চিকিৎসক, শিক্ষক, সহযোদ্ধা, কৃষিবিশেষজ্ঞ হিসেবে- ঔপনিবেশিক হিসেবে নয়
তারা এসেছিলেন উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে
তারা আমাদের সঙ্গে এক তাঁবুতে থেকে লড়াই করেছেন
শত শত কিউবান জীবন দিয়েছেন
... এমন নিঃস্বার্থ আন্তর্জাতিকতাবাদের বিরল নিদর্শন আমরা কখনো ভুলব না
অন্যদিকে ১৯৮৭ সালেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এএনসি ও ম্যান্ডেলাকে বলেছিলেন, 'সন্ত্রাসবাদী'
১৯৮৬ সালে মার্কিন কংগ্রেসে পাস হওয়া বর্ণবিদ্বেষবিরোধী আইনে ভেটো দিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান
এই সকল ঘটনা প্রমাণ করে, পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ কত নিকৃষ্ট ও অমানবিক
অন্যদিকে সমাজতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে
অন্যান্য দিক ছাড়াও মানকিক দিক দিয়েও সমাজতন্ত্র অনেক শ্রেষ্ঠ
পুঁজিবাদ মৌলিকভাবে শোষণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বলেই বর্ণবাদ ও বর্ণবিদ্বেষ লালন করে
অন্যদিকে সমাজতন্ত্র হচ্ছে এ যাবৎকালের ইতিহাসের সবচেয়ে মানবিক সমাজব্যবস্থা- যা গোটা বিশ্বে সব ধরনের নিপীড়ন শোষণ বৈষম্য বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সাম্য ভ্রাতৃত্ব মৈত্রীর মহান আদর্শকে বাস্তবে রূপাদন করে
ম্যান্ডেলার বন্ধু ছিলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো, লিবিয়ার গাদ্দাফি এবং ইয়াসির আরাফাত
সশস্ত্র সংগ্রামের সপক্ষে সাহায্য সংগ্রহের জন্য যখন (১৯৬১ সালে) এএনসির সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে নেলসন ম্যান্ডেলা গোপনে আলজিরিয়া গিয়েছিলেন তখন তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল চে গুয়েভারার
পরে ম্যান্ডেলা তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন
তিনি বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলোর কাছেও তিনি সাহায্য চেয়েছিলেন
কেউ সাহায্য করেনি
দুই একজন ছোটখাটো মন্ত্রী ছাড়া আর কারোর সাক্ষাৎ পর্যন্ত পাননি
কিন্তু কিউবার শীর্ষস্থানীয় নেতারা তাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, "কী কী প্রয়োজন ও জরুরি, তা বলুন
" তাঁরা সব ধরনের সাহায্যের অঙ্গীকার করেছিলেন এবং বাস্তবে সেই সাহায্য এসেছিল
সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের প্রতি ম্যান্ডেলার চরম ঘৃণা ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত
রাষ্ট্রপতি হিসেবেও এবং পরবর্তীতেও ম্যান্ডেলা তার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছিলেন
মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি ডিক চেনিকে তিনি বলেছিলেন 'ডাইনোসর'
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ১৯৮৫ সালে মার্কিন কংগ্রেসে ম্যান্ডেলার মুক্তির আরজি জানিয়ে একটি বিল আসলে চেনি তার বিরোধিতা করেছিলেন
ইরাক যুদ্ধের ব্যাপারে তিনি মার্কিন ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সম্পর্কে ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, "লোকটা কোনো ভালো চিন্তাই করতে পারে না
তিনিই বিশ্বে গণহত্যা চালাবেন
আর সবকিছুই করছেন ইরাকের তেলের জন্য
" বুশের তথাকথিত 'সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে'র তীব্র সমালোচক ছিলেন ম্যান্ডেলা
তিনি মার্কিন দেশের বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন
১৯৯০ সালে নিউইয়র্কে কৃষ্ণবর্ণের আমেরিকানদের সমাবেশে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের প্রশংসা করেছিলেন
ইজরাইল নিয়ে মার্কিনের ভন্ডামিপূর্ণ ভূমিকার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেছিলেন (২০০২ সাল, নিউজ উইক পত্রিকা), "বুশ বা টনি ব্লেয়ার, কেউই ইরাকে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্রের প্রমাণ দিতে পারেননি
আমরা জানি, গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে ইজরাইলের কাছে
কিন্তু এ নিয়ে কেউ কথা বলে না
সাম্রাজ্যবাদের চোখ রাঙানিকে ভয় পাবার মানুষ নন তিনি, যিনি জীবনের ২৭ বছর ওদের পোষ্য বর্ণবাদীদের কারাগারে নির্যাতিত হয়েছেন
তাছাড়া সাম্রাজ্যবাদ- বিরোধিতা ছিল তাঁর মতাদর্শ ও রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ
রাষ্ট্রনায়ক ম্যান্ডেলা: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উদ্বোধন: লক্ষ্য সমাজতন্ত্র
নেলসন ম্যান্ডেলা কেবল সংগ্রামী নেতাই ছিলেন না
তিনি ছিলেন একজন দক্ষ ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক
তিনি সাধারণ রাজনীতিবিদ নন, তাঁর মধ্যে ছিল সেই স্টেটসম্যানশিপের গুণাবলি, যা বিশ্ব ইতিহাসে স্বল্পসংখ্যক রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে ছিল
তিনি বর্ণবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উদ্বোধন ঘটালেন
সংখ্যালঘু কিন্তু দীর্ঘসময়ের অত্যাচারী শ্বেতাঙ্গদের প্রতি তিনি প্রতিহিংসামূলক আচরণ করেননি, যা করাটা অস্বাভাবিক বলে বিবেচিত হতো না
কারণ শ্বেতাঙ্গদের এতকালের আচরণ ও অত্যাচার এতই বর্বর ছিল যে, সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গরা তার কিছুটা প্রতিশোধ নেবে না, এমনটা ভাবা যায় না
কিন্তু শ্বেতাঙ্গরা তো পরাজয় বরণ করে নিয়েছে
ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে এবার কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানরা তাদের প্রতি অনুরূপ আচরণ না করে বরং ক্ষমা প্রদর্শনের মতো মহত্ত দেখাতে পেরেছিলেন
এই প্রসঙ্গেই নেলসন ম্যান্ডেলা 'জাতীয় পুনর্মিত্রতা বা সামঞ্জস্য বিধানে'র ( ) নীতির উদ্বোধন ঘটিয়েছিলেন
এটি ছিল একটি নতুন ধারণা, যার তাৎপর্য ছিল যুগান্তকারী ও আন্তর্জাতিক
কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানরা এইভাবে সভ্যতার একটা নতুন মান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন
অন্যদিকে বর্ণবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গরা ইতিহাসের পাতায় নিকৃষ্ট হিসেবেই স্থান পাবে, তারা নিজেদেরকে সভ্যতার স্তরে উন্নীত করতে পারেনি
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গদের আফ্রিকায় চরম বর্বর আচরণের জন্য পশ্চিমা সাদা চামড়ার কবির প্রতি আহ্বান রেখেছিলেন-
"বলো, ক্ষমা করো
হিংস্র প্রলাপের মধ্যে
সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী
শক্তিগর্বে মত্ত পশ্চিমা সাদারা তা পারেনি
কিন্তু ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গরা পরাজিত শোষক সাদাদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে সভ্যতার উন্নততর ধাপ তৈরি করলেন
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদীরা জনগণের সংগ্রামের কাছে মার খেয়ে এশিয়া-আফ্রিকা থেকে, উপনিবেশ দেশ থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল
সবশেষে মুক্ত হলো দক্ষিণ আফ্রিকা
সংখ্যালঘু শাসনের অবসান
বর্ণবাদ থেকে মুক্ত
ফাসিস্ত শাসন থেকে মুক্ত
এই মুক্তিকে সংহত করা খুব সহজ কাজ ছিল না
দক্ষিণ আফ্রিকার সমাজেও বহু ট্রাইব আছে, তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও সংস্কৃতি আছে
উপরন্তু চার শতাংশ শ্বেতাঙ্গ আছে
সর্বোপরি দেশটিতে কোনো গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও প্রতিষ্ঠান ইতিপূর্বে গড়ে ওঠেনি
কিন্তু এত সত্ত্বেও দুই দশক ধরে সেই দেশে গণতান্ত্রিক শাসন চলে আসছে
সাদা কালো সকল মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকৃত
নিয়মিত নির্বাচন হচ্ছে
যদিও এএনসি ও কমিউনিস্ট পার্টি যৌথভাবে বিজয়ী হয়ে আসছে, তবু সেটাকে একদলীয় শাসন বলা যাবে না
বহু দল ও মতের বৈধ অস্তিত্ব আছে
আফ্রিকার অনেক দেশেই যখন একদলীয় শাসন, সামরিক শাসন, গোত্রগত সংঘর্ষ, নৈরাজ্য ছিল বা এখনো বিরাজ করছে, তখন সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকায় চালু রয়েছে চমৎকার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা
ম্যান্ডেলা -এর নীতি গ্রহণ করলেও (যে কারণ পাশ্চাত্যের মিডিয়া ও রাজনীতিবিদরা এখন প্রশংসায় পঞ্চমুখ) তিনি কিন্তু এর দ্বারা বর্ণগত ও শ্রেণীগত বৈষম্যকে মেনে নেননি
এইরূপ ভুল বোঝার কোনো অবকাশ নেই
-এর নীতি সম্পর্কে দক্ষিণ আফ্রিকান কমিউনিস্ট পার্টি ব্যাখ্যা করেছে এইভাবে-
" , , . , , , . ."
হ্যাঁ, ম্যান্ডেলা পুঁজিবাদী শোষণ ও শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিলেন
তার রাজনৈতিক কর্মনীতির দুইটি বড় স্তম্ভ ছিল- ১. সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যাভিমুখী আর্থব্যবস্থা, ২. কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে দৃঢ় ঐক্য
মুক্তি অর্জনের পর থেকেই এএনসি ও কমিউনিস্ট পার্টি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে আসছে এবং প্রত্যেকবার বিজয়ী হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সরকার গঠন করে আসছে
ম্যান্ডেলা যে ধারার প্রবর্তন করে গিয়েছিলেন, তা এখনো অব্যাহত আছে
ম্যান্ডেলা ও তাঁর অনুগামীরা সকলেই সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে আন্তরিকভাবে অঙ্গিকারবদ্ধ
অনেক দেশে দেখা গেছে, কখনো কখনো বুর্জোয়া নেতারাও জনগণকে ধোঁকা দেবার জন্য ভুয়া সমাজতন্ত্রের স্লোগান তোলেন
না, তেমনটি ছিল না ম্যান্ডেলার ক্ষেত্রে
এই ক্ষেত্রে বিশ্বের আরেক রাষ্ট্রনায়ক সান-ইয়েৎ-সেনের সঙ্গে ম্যান্ডেলাকে তুলনা করা চলে
উভয় নেতাই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে দৃঢ় ঐক্যকে তাদের রাজনৈতিক নীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বলে ঘোষণা করেছিলেন