content
stringlengths
0
129k
তারা কেবল মহাদেশটি দখলই করেনি, আফ্রিকা থেকে মানুষ শিকারের ব্যবসা চালিয়েছিল কয়েক শতাব্দী ধরে
আমেরিকা মহাদেশে ও কৃষ্ণ আফ্রিকায় ইউরোপীয় বুর্জোয়ারা যা করেছিল তা ছিল ইতিহাসের বর্বরতম অধ্যায়
একেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, "সভ্যের বর্বর লোভ"
ইউরোপীয় দস্যুর দল পশু শিকারের মতো মানুষ শিকার করত আফ্রিকায়, তারপর তাদের হাতে পায়ে গলায় শিকল পরিয়ে আমেরিকায় 'দাসের হাটে' বিক্রি করত
এদেরকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষ ধরার দল
সপ্তদশ শতাব্দীতেই প্রতি বৎসর আমেরিকার দাসের বাজারে গড়ে বিক্রি হতো পঞ্চান্ন হাজার আফ্রিকার কালো মানুষ
পরবর্তী শতাব্দীতে এই দাস ব্যবসা আরো বৃদ্ধি পায়
আফ্রিকায় মানুষ শিকারের সংখ্যাও দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়
বুর্জোয়াদের জন্য এটা ছিল লাভজনক ব্যবসা
শুধুমাত্র ব্রিটিশ কলোনিতেই ১৬৮০ থেকে পরবর্তী একশ বছরে ২১ লাখ আফ্রিকানকে দাস বানিয়ে চালান দেয়া হয়েছিল
পুঁজিবাদ আধুনিক যুগে নতুন করে প্রবর্তন করল দাসশ্রম
কার্ল মার্কস তার বিখ্যাত "পুঁজি" গ্রন্থে এই চরম অমানবিক দাস ব্যবসা ও লুণ্ঠনকে ইউরোপীয় পুঁজিপতিদের জন্য আদি পুঁজি সঞ্চয়ের উৎস হিসেবে উল্লেখ করেছেন
সামির আমিনও বলেছেন যে, "পশ্চিম ইউরোপের বুর্জোয়ার সম্পদ সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে অধীনস্ত লাতিন আমেরিকা
আর কৃষ্ণ আফ্রিকা পরিধিরও পরিধিতে ( ) অবস্থান করে আমেরিকার বড় বড় খামার বাগানে দাস শ্রম সরবরাহ করেছিল
খোদ আফ্রিকাতে যে ব্রিটিশ ও অন্যান্য ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের বর্বর লোভ নিষ্ঠুর লুণ্ঠন করেছে, মানুষ শিকার করেছে, রক্তাক্ত করেছে আফ্রিকার মাটি, সেই দস্যুদল সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,
"এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে
এল মানুষ ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে
সভ্যের বর্বর লোভ
নগ্ন করলো আপন নির্লজ্জ অমানুষতা
মানুষ ধরার দল মূলত এসেছিল আফ্রিকার পশ্চিম পাশে
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে মানুষ চালানের ঘটনা তেমন না থাকলেও শ্বেতাঙ্গ দস্যুর দল সেখানে আফ্রিকানদের নিজ দেশেই দাস বানিয়েছিল
পুঁজিবাদী ইউরোপ থেকে লুণ্ঠনকারীরা দক্ষিণ আফ্রিকায় এসেছিল উনবিংশ শতাব্দীতে
প্রথমে এসেছিল অ-ইংরেজ অন্যান্য শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়রা
এদেরকে বলা হতো বুয়ার্স
পরে আসে ইংরেজরা
লুণ্ঠনকারীদের নিজেদের মধ্যে লুটের ভাগ নিয়ে মারামারি ছিল
বুয়ার্সরা কালো মানুষদের উচ্ছেদ করে রিপাবলিক গঠন করেছিল ট্রান্সভালে
এদিকে ঐ অঞ্চলের প্রতি নজর পড়ে ইংরেজদের
১৮৬০-এর দশকে অরেঞ্জ রিভারে হীরকের খনি এবং ১৮৮০-এর দশকে ট্রান্সভালে স্বর্ণের খনি আবিষ্কারের পর ব্রিটিশদের লোভ আরো বেড়ে গেল
উপরন্তু সমগ্র আফ্রিকাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তারা কায়রো থেকে কেপটাউন পর্যন্ত- উত্তর থেকে দক্ষিণে দীর্ঘ রেললাইন স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে
সেইজন্য দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বুয়ার্সদের সরিয়ে এই অঞ্চলকে নিজ দখলে নেয়া দরকার মনে করল ইংরেজরা
এই কারণেই বুয়ার্সদের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ হয়
১৮৯৯ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত চলে এই যুদ্ধ
বড়ই নির্মম ছিল এই যুদ্ধ
বুয়ার্স যুদ্ধের বীভৎসতা রবীন্দ্রনাথকে বেদনাহত করেছিল
তিনি লিখেছিলেন,
"... দয়াহীন সভ্যতানাগিনী
তুলেছে কুটিল ফনা চক্ষের নিমেষে
গুপ্ত বিষদন্ত তার ভরি তীব্র বিষে
[নৈবেদ্য, কবিতা নম্বর ৬৪]
এই যুদ্ধে বুয়ার্সরা তীব্র প্রতিরোধ সৃষ্টি করলেও সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষরা যোগদান করেননি
কারণ সাদা চামড়ার বুর্য়াসরাও তো ছিল পরদেশী লুণ্ঠনকারী ও নিষ্ঠুর শোষক
একইভাবে দেখা যায়, প্রায় কাছাকাছি সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের নিয়ে মহাত্মা গান্ধী যে ইংরেজ শাসনের বর্ণবাদ ও বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন তার সঙ্গেও কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের কোনো সম্পর্ক ছিল না
সেই ভারতীয়রা শোষক ছিল না, তারা ছিল নিরীহ ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ইত্যাদি
মহাত্মা গান্ধীও আফ্রিকানদের জড়ো করার চেষ্টা করেননি
অন্যদিকে আফ্রিকানদের মধ্যে তখনো যথেষ্ট সচেতনতা তৈরি হয়নি
সচেতন করে তোলার ক্ষেত্রে ম্যান্ডেলার বিশেষ ভূমিকা ছিল
বুয়ার্সদের পরাজিত করার পর ইংরেজরা দক্ষিণ আফ্রিকার পুরো অঞ্চলটি দখলে আনল
১৯১০ সালে ট্রান্সভাল, অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট এবং ইতিপূর্বে দখলকৃত কেপ কলোনি ও নাটালকে একত্রিত করে দক্ষিণ আফ্রিকার ইউনিয়ন নামে এক নতুন ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের রাষ্ট্রের জন্ম দিল
পরে তারা দেশটিকে স্বাধীনতা দিয়েছিল এই অর্থে যে, জনগোষ্ঠীর মাত্র চার শতাংশ শ্বেতাঙ্গের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল
কৃষ্ণবর্ণের মানুষরা নিজ দেশেই পরাধীন হয়ে রইল
বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার ছিল চরমভাবে ফাসিস্ত
এমনকি হিটলারের চেয়েও নিকৃষ্ট
কৃষ্ণবর্ণ আফ্রিকান জনগণের কোনো অধিকারই ছিল না
প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশটির জনগণ ছিল শোষিত ও চরমভাবে দরিদ্র
তাদের জন্য না ছিল স্বাস্থ্যসেবা, না ছিল শিক্ষার সুযোগ
বর্ণবাদ ছিল নিকৃষ্ট ধরনের
বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধেও দুইটি দেশেই বর্ণবাদ চালু ছিল
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ আফ্রিকায়
ষাটের দশক পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান আমেরিকানদের কোনো নাগরিক অধিকার ছিল না
এমনকি তাদের হত্যা করাও কোনো অপরাধ বলে গণ্য হতো না
গাছের সঙ্গে বেঁধে গরু-ছাগলের মতো চামড়া ছিলে হত্যা করার ঘটনাও ছিল অসংখ্য, গত শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাটের দশকেও
এই প্রক্রিয়ায় হত্যাকে বলা হতো লিনচিং
বিখ্যাত সাহিত্যিক মার্ক টোয়াইন তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম দিয়েছিলেন
মতাদর্শ (প্রতিক্রিয়াশীল ও বর্ণবাদী) এক হওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসকদের পরিপূর্ণ সমর্থন দিয়ে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদও বর্ণবাদী রাষ্ট্রকে মদদ দিয়ে এসেছে
বস্তুত দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী রাষ্ট্র তো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদেরই তৈরি
এইরকম এক ঘোর বর্ণবাদী ঔপনিবেশিক যুগে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা, ১৯১৮ সালে
দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তি সংগ্রাম এবং নেলসন ম্যান্ডেলা
সেই সময় কৃষ্ণ আফ্রিকানদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার হয়নি
অধিকাংশ কালো মানুষ ছিল সস্তা শ্রমের সরবরাহকারী
তখন অল্পসংখ্যক আফ্রিকান, যারা শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন ম্যান্ডেলা তাদের একজন
তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে ডিগ্রি লাভ করেন এবং আইন ব্যবসা শুরু করেন জোহেন্সবার্গে
এই সময় তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে () যোগদান করেন; ১৯৪৪ সালে
আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস ছিল কৃষ্ণ আফ্রিকানদের বৈধ সংগঠন, যারা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রচার করতেন
১৯১২ সালে এই সংগঠনটির জন্ম হয়েছিল
অবশ্য ১৯২৩ সালে তা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস নামটি গ্রহণ করেছিল
তিনি এই সংগঠনের যুব সংস্থা গড়ে তোলেন
তাঁর নেতৃত্বে এএনসি'র যুব সংগঠন সারা দেশে বিস্তৃতি লাভ করেছিল
বর্ণবাদ ও উপনিবেশবাদবিরোধী চেতনা দৃঢ়তর ও গভীরতর হয়েছিল তরুণ কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে
এএনসি দীর্ঘসময় শান্তিপূর্ণ প্রচারমূলক সংগ্রাম পরিচালনা করেছে
বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামই ছিল তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি
এর বাইরে অন্যকিছু নয়
নেলসন ম্যান্ডেলা একই সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনেও জড়িয়ে পড়েন এবং নেতৃত্ব প্রদান করেন, যে কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার ফাসিস্ত সরকার তাঁর বিরুদ্ধে আনীত মামলায় "শ্রমিকদের উসকানি"র অভিযোগও এনেছিল
পঞ্চাশের দশকে ম্যান্ডেলা মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন
১৯৫০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল
কয়েক বৎসর পর আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল
পঞ্চাশের দশকে আন্দোলনও যেমন তীব্র হয়ে উঠেছিল, তেমনই সরকারের দমন-পীড়নও বাড়তে থাকে
'সাপ্রেশন অফ কমিউনিজম অ্যাক্ট' নামে আইনটি এই সময় প্রণীত হয়েছিল
১৯৬১ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা আত্মগোপনে যান
১৯৬২ সালে গ্রেফতার হবার সময় তিনি কেবল এএনসির নেতা ছিলেন তাই-ই নয়, তিনি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও ছিলেন
ইতোমধ্যে এএনসি ও কমিউনিস্ট পার্টি উভয়ই সশস্ত্র সংগ্রামের লাইন গ্রহণ করে
১৯৬১ সালের নভেম্বরে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সশস্ত্র শাখা উমখোনতো উই সিজোয়ের প্রতিষ্ঠা হয়, যার প্রধান ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা
সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রশিক্ষণ চাই, অস্ত্র চাই
কয়েকটি আফ্রিকান দেশ এএনসির সশস্ত্র যোদ্ধাদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল
আর অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল সোভিয়েত চীনসহ সমাজতান্ত্রিক শিবির
আফ্রিকার সশস্ত্র বিপ্লবী যুদ্ধে ফিদেল কাস্ট্রোর নেতৃত্বাধীন কিউবারও বড় ভূমিকা ছিল
১৯৬২ সালের ১১ জানুয়ারি ম্যান্ডেলা গোপনে ডেভিড মোৎসামাই ছদ্মনামে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে আসেন