content
stringlengths 0
129k
|
---|
স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আদনান তুমি আজকে পিটিতে অংশগ্রহণ করোনি কেনো? আমি কিছু না বুঝেই স্যারের মুখের উপর বলে দিলাম, স্যার এই পিটি করে কি হবে, প্রত্যেক দিন রোদে দাঁড়াতে ভালো লাগে না |
শুধু এই কথাটি বলার সাথে সাথে স্যার আমাকে অনেক কটু কথা বলেছিলেন সেদিন |
যেটি সহ্য করার ক্ষমতা আমার তখনো হয়নি |
আমি সবেমাত্র স্কুলে নতুন ভর্তি হয়েছি |
আর আমার সাথে এমন বড় একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটলো এই কথা ভেবে আমার তিনটি মাস চলে গেলো ধুঁকে ধুঁকে |
স্কুল শেষে যখন বাসায় ফিরতাম, তখন আমার ওইদিনকার কথা মনে পড়লে আর ভালো লাগতো না |
সবাই আমাকে নিয়ে ওইদিন কি রঙ্গ-তামাশাটাই না করলো! তারপরেও নিজের মনকে বোঝলাম, সময় এখানেই শেষ নয়, ধৈর্য ধরা শিখলাম |
এটুকু বলে আদনান থামলো |
সাথে এক গ্লাস পানিও পান করলো |
এই তিনমাসে সব কিছু ঠিক ঠাক করে নিজেকে আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তোলে আদনান |
যে না, সেও ভালো কিছু করতে পারবে |
কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস |
একটির ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দ্বিতীয় ধকল এসে পরে তার উপর |
দশম শ্রেণীতে টেস্টে ফেল করা, তাও একবার দুবার না, পর পর তিনবার |
আদনান যেনো নিজেকে নিজে বিশ্বাস করতে পারছিলো না তখন |
তখন তার চোখেমুখে শুধুই হতাশার ছাপ দেখতে পাওয়া যেতো |
একই ক্লাসে বার বার পড়ে থাকার কারণে জুনিয়রদের এবং ক্লাসের শিক্ষকদের নানা কটু কথা শুনতে হতো তার |
কিন্তু সে ধৈর্যহারা না হয়ে রবাট ব্রুসের মতো নিজেকে তৈরি করে |
ঠিক ৪র্থ বার মেধাতালিকায় সেরা হয়ে স্কুলের সুনাম বয়ে আনে |
আদনান বলে, কটু কথার জবাব দিতে হয় সাফল্যের মাধ্যমে |
কখন ধৈর্যহারা হবেন না |
আমি এই জীবনে কখনো ধৈর্যহারা হইনি |
আর এর ফলস্বরূপ এখন আমি একজন গর্বিত সরকারি সেনা কর্মকর্তা |
এটুকু বলে আদনান একবার ঢোক গিলে |
তারপর সুন্দর একটি উক্তি বলে 'জীবনে ধৈর্য কেউ কাউকে ধরে ধরে শিখায় না, সময়ের সাথে সাথে মানুষ এমনি ধৈর্য ধরা শিখে যায়' |
পবিত্র কোরআনে আছে, ধৈর্যশীলদেরকে তো অপরিমিত পুরস্কার দেয়া হবে |
ধৈর্য ধারনকারীর সাফল্য সুনিশ্চিত |
(সূরা যুমার, ১০ আয়াত) |
আমি মোটেও কচি খোকাটি নই |
মধ্য তিরিশের পরিণত যুবক |
জীবনের অলিগলিতে প্রচুর হেঁটেছি |
মার খেয়েছি, পালিয়েছি, হোঁচট খেয়ে আবার উঠেও দাঁড়িয়েছি |
কিন্তু এমন আতান্তরে আর কখনো পড়িনি! প্রচণ্ড গরম পড়েছে |
সামনে রাখা ঠাণ্ডা লেবুজলের গ্লাস মুহুর্তে ফাঁকা করে দিয়ে যখনই রাখতে গেছি, তখনই সামনের দিকে তাকিয়ে মনে হলোঃ আবার তেষ্টা পেয়েছে |
এ পিপাসা অন্য পিপাসা! |
কিছু দিন আগের কথা বলি |
মমিনুর রহমানকে অনেকদিন বাদে ভাঙ্গামোড় বাজারে আবিষ্কার করে ফেললাম |
আমি, সাদমান রাহী শহরেই থাকি |
বহুদিন পর গ্রামে বেড়াতে এসেছি |
থাকবো কিছুদিন |
শহরের একাকী কাঠখোট্টা জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম |
তাই এই প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়াতে আসা |
কিন্তু মমিন ভাইকে যে পেয়ে যাবো, সেটা ভাবিনি! প্রায় বিশ বছর আগেই তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন |
আমার তখন কতইবা বয়স হবে? ১২ কিংবা ১৩ আর মমিনের তিরিশ? তখন একটা ঘটনা ঘটেছিলো যেজন্য মমিন ভাইকে ভোলা আমার পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব না! ফ্লাশব্যাকে সব মনে পড়ে গেলো |
এতদিন বাদেও লোকটার তেমন পরিবর্তন ঘটেনি - কেবল কাঁচাপাকা চুলেই বয়স উঁকি মারছে! আমাকে দেখে চিনতে পেরে সে কি খুশী! নানান কুশল জিজ্ঞাসার পর বললেন, 'বাড়িতে আসিস, সদু |
চিনবি তো? ঐ যে বড় পাগারের ধার ঘেঁষে যে রাস্তাটা গেছে, তার মাথায়...' |
'আমার মনে আছে' জায়গাটা গ্রাম থেকে একটু দূরে ঘন জংলামত হলেও যাওয়া যায় |
একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলামঃ |
'আমাকে মাফ করছো, মমিন ভাই?' |
'পুরনো সেসব কথা থাক, সদু |
তাইলে আসিস কিন্তু, ভুলে যাইস না |
একটা সারপ্রাইজও আছে' |
'হ্যাঁ, আসবো |
কী সারপ্রাইজ?' |
'আসলেই দেখতে পাবি...এই শুক্রবার বাদ জুমা আয়...' |
যথারীতি ভুলে গেলাম |
মনে পড়লো পরের শুক্রবারে |
ভাবলাম - গিয়েই দেখি, যেতেই তো বলেছে...পরের শুক্রবার - কী এমন তফাৎ? |
দরজায় কড়া নাড়লে অনেকক্ষণ কারো সাড়া পাওয়া গেলো না |
শেষে চলে যাবো এমন সময় অশীতিপর এক বৃদ্ধা দরজা খুলে রাগি চোখে তাকিয়ে রইল |
স্পষ্ট বুঝতে পারছিঃ তাঁর দুপুরের ঘুমটা হারাম করে ফেলেছি |
কিন্তু এখন তো করার কিছু নাই! |
'কাকে চাও?' |
'আ...আমি সদু মানে সাদমান |
মমিন ভাই বাড়িতে নাই? আমাকে আসতে বলছিলো...' |
কালকে সকালে আসো |
একটু ঘুমাইতেও পারি না, যন্ত্রণা!' |
বুড়ির কোনো বোধবুদ্ধি নাই |
মেহমানকে একরকম তাড়িয়েই দিচ্ছে |
মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো |
উল্টো ঘুরে পা বাড়াতেই এক রিনরিনে গলার স্বর শোনা গেলো |
ভেতর থেকে কে যেন বুড়িকে তিরস্কার করে উঠলো, 'পরে ঘুমাও তুমি |
ওনাকে ভেতরে নিয়া আসো |
মেহমানকে এভাবে বিদায় দিতে নাই!' |
কী সুন্দর কন্ঠস্বর! গনগনে রাগের আগুনে যেন জল পড়ে গেলো |
এই মোহনীয় কণ্ঠের অধিকারিণীকে না দেখে কীভাবে যাবো- বুঝে উঠলাম না |
বুড়ি কিন্তু তখনও জ্বলছে |
'আসো, ভিতরে আসো |
এইখান দিয়া সোজা যাও |
ভরদুপুরে মেহমান? যন্ত্রণা!!' |
ভয়াবহ গরম পড়েছে |
ঝকঝকে লেপা উঠান তাওয়ার মত গনগন করছে |
যে ঘরটিতে বসতে দেয়া হলো, সেটা পেয়েই মনে হলো, স্বর্গে বসে আছি |
মাটির আধাপাকা ঘর |
যত্নের ছাপ সর্বত্র |
বাইরের আঁচ খুব একটা এসে পৌঁছাচ্ছে না |
গলা শুকিয়ে কাঠ... রুমালে ঘাম মুছছি |
এমন সময় আট/নয় বছরের একটা মেয়ে এসে ঝকঝকে গ্লাসে করে খানিকটা লেবুর শরবত দিয়েই উধাও হয়ে গেলো |
গ্লাসের শরীরে বিন্দু বিন্দু বাষ্প জমে আছে |
আর তর সইল না |
ঢকঢক করে এক চুমুকে গ্লাসটা সাবড়ে দিয়ে রাখতে গেছি, তখনই কাণ্ডটা হলো! কিন্নরকণ্ঠীকে দেখতে পাওয়া গেলো |
অসামান্য সুন্দর এক নারী দাঁড়িয়ে আছেন |
বয়স আন্দাজ করা শক্ত - মধ্য বিশ অথবা সদ্য ত্রিশের কোঠায়ও হতে পারে |
লালপেড়ে একটা শাড়ি বাংলা ধাঁচে পরনে |
সেখানে একটা গ্রামীণ সারল্য থাকলেও শরীরী ঐশ্বর্য প্রবল উচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙ্গে একটা অন্যায় আনন্দের উৎস হতে চাচ্ছে! কাটা কাটা চোখ-নাক-মুখ |
মুখে একটা অদ্ভুত হাসি - মৃদু কৌতুকের কি? আমার আবার বড্ড পিপাসা পেয়ে গেলো! |
'প্রথম দেখায় মরণ' জাতীয় আদিখ্যেতা আমি বরাবরই অস্বীকার করে এসেছি |
এসব ছেলেমানুষির কোনো মানে হয় না - এটা ভেবে অতীতে অনেক বিদ্রুপও করেছি |
সেই আমিই কিনা... আমার মনে হতে থাকলোঃ আমি যেন তলিয়ে যাচ্ছি |
স্থান-কাল-পাত্র ভুলে সেই রুপের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে হলো |